প্যানডোরার ক্যাপ্টেন। বিদ্রোহীদের খুঁজে বের করে ধরে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ওকে।
কিন্তু আমি তো বিদ্রোহ…
হ্যাঁ, তোমার ধারণা তুমি বিদ্রোহ করোনি, বাধা দিয়ে বললেন ডা. হ্যামিলটন, কিন্তু ব্লাইয়ের ধারণা-ধারণা নয় বিশ্বাস, তুমি শুধু বিদ্রোহই করোনি, বিদ্রোহ সংগঠনে গভীর ভাবে জড়িত ছিলে। বাউন্টি যে সকালে দখল করা হয় তার আগের রাতে ক্যাপ্টেন ব্লই নিজে ডেকে এসেছিলেন জানো?
হ্যাঁ।
তুমি আর ক্রিশ্চিয়ান এক মনে কি যেন আলাপ করছিলে।
হ্যাঁ।
তোমাদের আলাপের শেষ অংশটা ব্লাই শুনতে পেয়েছিলেন। তুমি তখন ক্রিশ্চিয়ানকে বলছিলে, আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেন, স্যার। জবাবে ক্রিশ্চিয়ান বলেছিল, বেশ, তাহলে, এই কথা থাকল,-তাই না?
নির্বাক হয়ে রইলাম আমি কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বললাম, ঠিক এই কথাগুলো না হলেও এরকমই কিছু আমরা বলাবলি করছিলাম। কিন্তু-কিন্তু তার সাথে বিদ্রোরে তো কোন সম্পর্ক ছিল না।
ছিল না! তুমি নিজেই ভেবে দেখ, বিয়্যাম, বিদ্রোহের নেতার সঙ্গে এ ধরনের আলাপ, তা-ও বিদ্রোহের ঠিক আগের রাতে-যে-ই শুনবে তোমরা বিদ্রোহের ব্যাপারটা পাকাপাকি করেছিলে এছাড়া কিছু ভাববে?
আমি এবার বিদ্রোহের ব্যাপারটা পুরোপুরি খুলে বললাম সার্জনকে। কিছুই বাদ দিলাম না। সে রাতে ক্রিশ্চিয়ানের সাথে আমার আলাপ থেকে শুরু করে আমাদের তাহিতিতে নামিয়ে দিয়ে আটজন সঙ্গী সহ ক্রিশ্চিয়ানের নিরুদ্দেশ যাত্রা পর্যন্ত সব মন দিয়ে শুনলেন ডা. হ্যামিলটন। তারপর বললেন, আমি বিশ্বাস করেছি তোমার কথা। তার প্রমাণ-, হাত এগিয়ে দিলেন তিনি। আমি হাতটা ধরে গভীর আবেগে একটু ঝাঁকিয়ে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু, বিয়্যাম, আমার বিশ্বাস অবিশ্বাসে তো কিছু আসবে যাবে না, বিশ্বাস করাতে হবে বিচারককে। বিচারকরা প্রমাণ ছাড়া কিছুই বিশ্বাস করেন না।
প্রমাণ তো আছে, স্যার। বললাম না, রবার্ট টিঙ্কলার শুনেছিল ক্রিশ্চিয়ানের সাথে আমার আলাপ। ও যদি সাক্ষী দেয়…
হ্যাঁ টিঙ্কলার, আমার মনে হয় ও সাক্ষী দেবে। ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের দলের সাথে ও-ও নিরাপদে পৌঁছেছে ইংল্যান্ডে। কিন্তু তারপরও কিছু সন্দেহ থেকে যাবে। ক্রিশ্চিয়ান যে ছোট্ট একটা ভেলায় চড়ে পালাতে চেয়েছিল তার প্রমাণ কি?
ক্রিশ্চিয়ান পালাতে চেয়েছিল কি না চেয়েছিল তার প্রমাণ কি আমার বিচারের জন্যে খুব জরুরী?
নিশ্চয়ই। তোমার সঙ্গে ওই আলাপের ব্যাপারটা নিঃসংশয়ে প্রমাণ করতে হলে ক্রিশ্চিয়ান যে পালাতে চেয়েছিল তা-ও নিঃসংশয়ে প্রমাণ করতে হবে। ও যে পালাতে চেযেছিল এ কথা তুমি ছাড়া আর কেউ জানে?
হ্যাঁ, জন নর্টন জানে। সে-ই ভেলা তৈরি করেছিল ক্রিশ্চিয়ানের জন্যে।
টেবিলের দেরাজ খুলে একটা কাগজ বের করলেন সার্জন।
ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের সঙ্গে যারা লঞ্চে উঠেছিল তাদের তালিকা এটা। ওদের মোট বারোজন ইংল্যান্ডে পৌঁছুতে পেরছে। একটু থেমে কাগজটার ওপর চোখ বুলালেন ডা. হ্যামিলটন। তারপর বললেন, নর্টন?…না নর্টন নেই ওদের ভেতর। এখানে বলা হয়েছে, তোফোর দ্বীপে জংলীদের হাতে মারা পড়েছে ও।
নর্টন নেই শুনে দুঃখ পেলাম। কিন্তু যতটা দুঃখ পেলাম তার চেয়ে বেশি হলাম হতাশ। মিস্টার নেলসনও মারা গেছেন। কুপ্যাঙ-এ পৌঁছে কি এক অজানা রোগে পড়েছিলেন। উনি যদি থাকতেন, বিচারকদের সামনে বলতে পারতেন, সত্যিই আমি জাহাজ ছেড়ে লঞ্চে উঠতে চেয়েছিলাম। অর্থাৎ আমার পক্ষে সাক্ষী থাকল মোটে একজন-ওই টিঙ্কলার। ভীষণ হতাশ লাগতে লাগল আমার। কিন্তু ডা. হ্যামিলটন অভয় দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন:
ভেঙে পোড়ো না, বিয়্যাম। এখন যেটা তোমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো মন শক্ত রাখা। দেখাই যাক না টিলারের সাক্ষীতে কতটুকু কাজ হয়। এর ভেতর নিশ্চয়ই আরও কোন প্রমাণের কথা মনে পড়ে যাবে আমাদের! স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস তোমার সপক্ষে সামান্যতম প্রমাণও যদি পাওয়া যায় হাজির করতে ছাড়বেন না আদালতের সামনে।
শুনে সামান্য হলেও স্বস্তি পেলাম। এরপর ব্লাই ও তার সঙ্গীরা কি করে কুপ্যাঙ হয়ে ইংল্যান্ডে পৌঁছেছেন সংক্ষেপে সে গল্প শোনালেন হ্যামিলটন। প্রথমে ওঁরা তোফোয়া দ্বীপে গিয়েছিলেন পানি এবং খাবার দাবার সংগ্রহ করার জন্যে। সেখানে জংলীদের খপ্পরে পড়েন। পুরো দলটাই ধ্বংস হতে হতে বেঁচে যায় অল্পের জন্যে। নর্টন একাই কেবল মারা পড়ে। এরপর কঠোর পরিশ্রম আর কষ্ট ভোগ করে বিদ্রোহের সাতচল্লিশ দিন পর ওঁরা পৌঁছান ওলন্দাজ উপনিবেশ টিমোর-এর কুপ্যাঙ-এ। তারিখটা জুনের চোদ্দ। কুপ্যাঙ এ পৌঁছানোর জন্যে কমপক্ষে বারোশো লিগ সাগর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে ওদের। দুমাস এখানে থেকে একটু সুস্থ হওয়ার পর হোট একটা স্কুনারে করে বাতাভিয়ায় চলে আসেন তারা। কুপ্যাঙ-এ মারা গিয়েছিলেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ডেভিড নেলসন, বাতাভিয়ায় মারা যায় আরও তিন জন-এলফিনস্টোন, লেকলেটার আর টমাস হল। সহকারী সার্জন লেডওয়ার্ড স্বাস্থ্যগত কারণে বাতাভিয়ায় থেকে যায়, বাকিরা ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটা জাহাজে চড়ে দেশে ফেরে। পথে মারা যায় কসাই ল্যাম্ব। অর্থাৎ উনিশ জনের ভেতর ইংল্যান্ডে পৌঁছায় মাত্র বারোজন।