আমি যা জানি বলেছি, স্যার।
মানে বাউন্টি এখন কোথায় তুমি বলবে না? ঠিক আছে, আমার কথাটা তাহলে শুনে রাখো, আমি ওটা খুঁজে বের করব। এবং যে বদমাশরা ওটা নিয়ে গেছে তাদের হাজি করব বিচারকের সামনে হা, শুনে রাখো, সে জন্যেই পাঠানো হয়েছে আমাকে।
দ্রুত চিন্তা চলছে আমার মাথায়। কি করে এ সম্ভব? ব্লাই নিজের চোখে দেখেছেন আমি বিদ্রোহে অংশ নেইনি, আমি তার সাথে যেতে চেয়েছি লঞ্চে-শুধু ব্লাই কেন, নেলসন, পার্সেল এবং আরও অনেকে দেখেছে। তার পরেও কি করে তিনি অ্যাডমিরালটিকে জানান বিদ্রোহে আমার ভূমিকা ছিল? ব্যাপারটা মস্ত এক ধাঁধার মত মনে হলো আমার কাছে জানতে ইচ্ছে হলো, ব্লাইয়ের সঙ্গে যারা গিয়েছিল তাদের কজন কি অবস্থায় দেশে পৌঁছেছে। কিন্তু আমাকে প্রশ্ন করার কোন সুযোগ দিল না ক্যাপ্টেন। বলল, উঁহু, তুমি নয়, প্রশ্ন করব আমি। এক মুহূর্ত বিরতি নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, তাহলে ক্রিশ্চিয়ান কোথায় আছে বলবে না?
আমি যা জানি বলেছি, স্যার!
লেফটেন্যান্ট এর দিকে ফিরল ক্যাপ্টেন।
মিস্টার পার্কিন, লোকটাকে নিচে পাঠিয়ে দাও। আর খেয়াল রাখবে কারও সাথে যেন যোগাযোগ করতে না পারে…একটু দাঁড়াও। হেওয়ার্ডকে আসতে বলো একবার তার আগে।
হেওয়ার্ড নামটা শুনে একটু যেন চমকালাম আমি। কিছুক্ষণ পর সে যখন কেবিনে ঢুকল, খুশিতে লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করল! হ্যাঁ। আমাদের সেই টমাস হেওয়ার্ড, বাউন্টিতে যে আমার মেসমেট ছিল! হাত বাড়িয়ে আমি এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। বিনিময়ে, ওর চোখে ফুটে উঠল তাচ্ছিল্য। হাত দুটো পেছনে নিয়ে দুপা পিছিয়ে গেল হেওয়ার্ড।
এই লোককে চেনো তুমি, মিস্টার হেওয়ার্ড?
হ্যাঁ, স্যার। ও রজার বিয়্যাম। বাউন্টিতে মিডশিপম্যান ছিল।
ব্যস, এতেই চলবে, বলল ক্যাপ্টেন।
তাচ্ছিল্যের চোখে আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেল হৈওয়ার্ড। এরপর রক্ষীরা আমাকে জাহাজের একেবারে নিচের ডেকে নিয়ে গেল। ভাড়ার ঘরের পাশে ছোট্ট একটা কুঠুরিতে আটকে রাখল শিকল দিয়ে বেঁধে। ঘন্টাখানেক পর স্টুয়ার্ট, কোলম্যান আর স্কিনারকে আনা হলো। একই ভাবে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হলো ওদেরও।
.
চোদ্দ
পরের চারটে দিন ওই ছোট্ট অন্ধকার কুঠুরিতে আটকা রইলাম আমরা। একে বিষুবীয় আবহাওয়া, তার ওপর বদ্ধ কুঠুরি। অসহ্য গরমে প্রাণ দুর্বিষহ হয়ে উঠল। খাবার যা দেয়া হলো তা এক কথায় জঘন্য। ইংল্যান্ড থেকে প্যানডোরা যে,শুকনো রুটি আর বিচ্ছিরি নোনা মাংস নিয়ে এসেছে তাই, ডাঙার তাজা খাবারের এক কণাও আমাদের দেয়া হলো না। ছোট্ট কুঠরিটায় চার চারজন মানুষ আমরা হাত পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থায়, দরজার কাছে সশস্ত্র রক্ষী। একটা কথা বলার উপায় নেই নিজেদের ভেতর। কথা বলতে গেলেই ধমকে থামিয়ে দেয় রক্ষীরা।
এইভাবে কাটল চার দিন। পঞ্চম দিন সকালে অতিরিক্ত একজন রক্ষী নিয়ে হাজির হলো কর্পোরাল। পায়ের শিকল খুলে আমাকে নিয়ে এল গান ডেকের একটা কেবিনে। কেবিনটা প্যানডোরার সার্জন ডা. হ্যামিলটনের। আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন তিনি।
আমি কেবিনে ঢুকতেই রক্ষীদের বিদায় করে দিলেন ডাক্তার। তারপরই তার চোখ পড়ল আমার হাতের হাত কড়ার ওপর। কর্পোরালকে ডাকলেন আবার। হাতকড়া খুলে দিতে বললেন।
লেফটেন্যান্ট পার্কিনের নির্দেশ…নিরাসক্ত কণ্ঠে শুরু করল কর্পোরাল।
হয়েছে, আর বলতে হবে না, বাধা দিলেন ডাক্তার হ্যামিলটন। খুলে নাও ওগুলো। আমি জামিন থাকছি এর।
আর কিছু না বলে হাতকড়া দুটো খুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল কর্পোরাল। দরজায় তালা লাগিয়ে দিলেন সার্জন।
সাবধান হলাম, মৃদু হেসে তিনি বললেন। না, মিস্টার বিয়্যাম, তুমি পালানোর চেষ্টা করবে ভেবে নয়। আমি চাই না আমাদের আলাপে কেউ বাধা সৃষ্টি করা। বসো। বছর চল্লিশেক বয়েস ভদ্রলোকের স্বাস্থ্যবান। সৌম্য, সুদর্শন। গলার স্বরে অদ্ভুত এক কোমল ভাব। ওঁর কাপড় চোপড়ের বাক্সটার ওপর আমি বসলাম।
প্রথমেই যেটা জানতে চাইব, শুরু করলেন তিনি, তোমার অভিধানের কাজ কতদূর? শেষ হয়েছে?।
স্যার, এ ধরনের কাজ কি এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়। তবে অনেক দূর এগিয়েছি। তাহিতীয় ভাষার একটা ব্যাকরণও আমার সাধ্যমত তৈরি করেছি।…কিন্তু-আপনি এসব কথা জানলেন কি করে?
স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস বলেছেন।
মানে-মানে আপনি স্যার জোসেফকে চেনেন!
আঁ-হ্যাঁ, খুব ঘনিষ্ঠভাবে নয় অবশ্য। নাম শুনেছি অনেক আগেই, পরিচয় হয়েছে আমরা রওনা হওয়ার কদিন আগে। তোমার সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা ওঁর।
তাহলে, স্যার, আপনি-আপনি নিশ্চয়ই বলতে পারবেন, এই বিদ্রোহের ব্যাপারটায় উনি আমাকে দোষী মনে করেন কিনা? আপনি, স্যার আপনি নিজেও কি মনে করেন এমন একটা কাজে জড়ানোর মত পাগলামি আমি করব?
না, অন্তত তোমার চেহারা দেখে আমার তা মনে হয় না।আর স্যার জোসেফের কথা যদি বলো, তোমার বিরুদ্ধে যা যা বলা হয়েছে সব সত্ত্বেও উনি মনে করেন তুমি নির্দোষ।
অথচ দেখুন, আপনাদের ক্যাপ্টেন এমন ব্যবহার করছেন, যেন আমি পালের গোদাদেরই একজন।
গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন সার্জন আমার দিকে।
এডওয়ার্ডসকে অবশ্য খুব একটা দোষ দেয়া যাবে না সেজন্যে, বললেন তিনি।
এডওয়ার্ডস।