বেশির ভাগ নাবিকই ডেকের ওপর, রেলিংয়ে ঝুঁকে তাকিয়ে আছে উপকূলের দিকে। কিছু লোক কৌতূহলী হয়ে দেখছে আমাদের। ক্যাপ্টেনকে দেখলাম কোয়ার্টার ডেকে, তার চোখের দূরবীন আমাদের দিকে তাক করা। জাহাজ আর আমাদের ক্যানো যখন পাশাপাশি হলো আমরা দাঁড় বেয়ে চললাম ওটার সঙ্গে সঙ্গে। গ্যাঙওয়ে থেকে একটা রশি ছুঁড়ে দেয়া হলো আমাদের দিকে। পাওটো রশিটা ধরে জাহাজের গায়ে নিয়ে লাগাল ক্যানো। আমি আর তুয়াহু উঠে পড়লাম জাহাজে। পাওটো ক্যানোতেই রইল।
রোদে পুড়ে আমার গায়ের রঙও এখন ইন্ডিয়ানদের মত বাদামী হয়ে গেছে, তার ওপর আমার গায়ে রয়েছে ইন্ডিয়ানদের পোশক, বাহুতে উল্কি। জাহাজের সবাই আমাকে তাহিতীয় বলে ভুল করল। গ্যাঙওয়েতে এক লেফটেন্যান্ট দাঁড়িয়ে ছিল। এগিয়ে এসে তুয়াহুর কাঁধ চাপড়ে দিয়ে সে বলল, মাইতাই! মাইতাই! অর্থাৎ, শাবাশ, শাবাশ! সন্দেহ নেই এই একটা ইন্ডিয়ান শব্দই জানে লেফটেন্যান্ট।
ওর সাথে ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন, মৃদু হেসে আমি বললাম। ইংরেজি ও ভালই বোঝে। আমার নাম বিয়্যাম, রজার বিয়্যাম; হিজ ম্যাজেস্টিজ শিপ বাউন্টির সাবেক মিডশিপম্যান আমি।
মুহূর্তে মুখের ভঙ্গি বদলে গেল লেফটেন্যান্টের। কোন জবাব না দিয়ে আপাদমস্তক দেখল আমাকে। তারপর চিৎকার করে ডাকল, কর্পোরাল!
এগিয়ে এসে সামরিক কায়দায় সালাম কল কর্পোরাল।
কয়েক জন রক্ষী নিয়ে এসে এই লোকটাকে পেছনে নিয়ে যাও!
চিৎকার করে একটা নির্দেশ দিল কর্পোরাল। অমনি চারজন মাস্কেটধারী নৌ-সেনা ছুটে এসে ঘিরে ফেলল আমাকে। অবাক হওয়ারও অবসর পেলাম না, কর্পোরালের নির্দেশ শুনতে পেলাম: এগোও! পিঠে অনুভব করলাম, মাস্কেটের খোঁচা।
এগোতে হলো আমাকে। সামনে সেই লেফটেন্যান্ট।
কোয়ার্টার ডেকে ক্যাপ্টেনের কাছে গিয়ে সে বলল, স্যার, গুণ্ডাওলোর একটাকে ধরেছি।
না, স্যার, প্রতিবাদ করলাম আমি। আমি গুণ্ডা নই। আপনারা…
থামো! গর্জে উঠল ক্যাপ্টেন। লেফটেন্যান্টের মতই আপাদমস্তক দেখল আমাকে নীরবে।
আমার কথা শুনুন, স্যার, আবার বললাম আমি। আমি বিদ্রোহী নই। আমার নাম…।
কথা কানে ঢোকেনি, বদমাশ? আমি তোমাকে চুপ করতে বলেছি!
রাগে লজ্জায় আমার কান ঝা ঝা করতে লাগল। কিংকর্তব্যবিমূঢ়র মত দাঁড়িয়ে রইলাম চুপচাপ। ঘাড় ফিরিয়ে একবার দেখলাম, তুয়াহু দুচোখ ভর্তি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওকে কিছু বলার জন্যে মুখ খুললাম। আবার ধমক মেরে থামিয়ে দেয়া হলো আমাকে।
আর্মারারকে ডাকা হলো। আমার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল সে। তারপর কর্পোরালের তত্ত্বাবধানে রক্ষীরা ক্যাপ্টেনের কেবিনে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখল আমাকে।
দুঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। এর ভেতর রক্ষীদের ছাড়া আর কারও মুখ আমি দেখতে পাইনি। রক্ষীদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি কয়েকবার, আগের মতই ওরা ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে আমাকে। অবশেষে, প্যানডোরা মাতাভাইয়ে নিরাপদে নোঙ্গর করার পর, এল ক্যাপ্টেন। পেছনে সেই লেফটেন্যান্ট। আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল ক্যাপ্টেন। তারপর একটা চেয়ারে বসে ছুঁড়ে মারল প্রশ্নটা :
নাম কি তোমার?
রজার বিয়্যাম।
রাজার সশস্ত্র জাহাজ বাউন্টিতে মিডশিপম্যান ছিলে তুমি?
হ্যাঁ, স্যার।
বাউন্টির নাবিকদের কজন এখন তাহিতিতে আছে?
তিন জন, আমি যতদূর জানি, আমাকে ছাড়া।
নাম কি সেই তিন জনের?
জর্জ স্টুয়ার্ট, জোসেফ কোলম্যান আর রিচার্ড ফিনার।
ফ্লেচার ক্রিশ্চিয়ান কোথায়? বাউন্টিই বা কোথায়?
আটজন বিদ্রোহীসহ বাউন্টিতে করে ক্রিশ্চিয়ানের অজানার পথে চলে যাওয়ার কথা বললাম। তারপর থেকে এ পর্যন্ত তাহিতিতে যা যা ঘটেছে তা-ও বললাম। মরিসনের ছোট্ট একটা জাহাজ বানানো এবং তাতে করে মাত্র চারদিন আগে বাতাভিয়ার পথে রওনা হয়ে যাওয়ার কথাও বাদ দিলাম না।
হুঁ, গল্প হিসেবে মন্দ নয় যাহোক, গম্ভীর মুখে বলল ক্যাপ্টেন। তা তুমি কেন গেলে না ওদের সাথে?
ওইটুকুন জাহাজে ওরা অত দূরের পথ পাড়ি দিতে পারবে, আমার বিশ্বাস হয়নি।
হুঁ। কিন্তু শুনলে আশ্চর্য হবেনা কি দুঃখ পাবে?-ওর চেয়ে ছোট নৌকায় করে ক্যাপ্টেন ব্লাই তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে কুপ্যাঙ-এ পৌঁছেছিলেন; সেখান থেকে জাহাজে ইংল্যান্ডে।
সত্যিই, স্যার! ব্লাই, ইংল্যান্ডে পৌঁছুতে পেরেছেন?-ওহ, কি খুশি যে লাগছে শুনে!
হুঁ, কিন্তু তারপর উনি যা করেছেন শুনলে আর লাগবে না। দেশে পৌঁছেই বিদ্রোহের কথা জানিয়েছেন অ্যাডমিরালটিকে। তোমার জন্য ভূমিকার কথাসুদ্ধ।
আমার ভূমিকা! আমার কোন ভূমিকা ওতে ছিল না, স্যার। আমি আপনার এই জাহাজের নাবিকদের মতই নিরপরাধ!
মানে, ক্রিশ্চিয়ানের সঙ্গে জোট পাকিয়ে বাউন্টি দখলের ষড়যন্ত্র করেছিলে, একথা তুমি অস্বীকার করছ?
অবশ্যই, স্যার। এত কথা যখন জানেন তাহলে এটাও নিশ্চয়ই জানেন, ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের সাথে যাওয়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই লঞ্চে জায়গা ছিল না বলে যেতে পারেনি। আমরা মোট নজন ছিলাম, যারা বিদ্রোহে অংশ নেইনি তবু কপাল দোষে থেকে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম জাহাজে। ব্লাই চিৎকার করে বলেছিলেন, আমাদের যেন সুবিচার হয় উনি দেখবেন। তাহলে কেন আমার সাথে…
যথেষ্ট হয়েছে। আমাকে থামিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন। যথাসময়েই ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে তোমার। তখন তাকেই জিজ্ঞেস কোরো, কেন। এখন বলো, কোথায় গেলে পাব বাউন্টিকে?