সতেরোশো একানব্বই এল। শুরুটা, গেল বছরের মত সুখেরই হলো। জানুয়ারি চলে গেল, ফেব্রুয়ারিও। মার্চের মাঝামাঝি সময় কয়েক দিনের জন্যে ভেহিয়াটুয়ার সঙ্গে দ্বীপের অন্য পাশে গেল তেহানি, কি এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্যে। হেলেনকে নিয়ে গেল ও। আমি আর আমার শ্যালক তুয়াহু রইলাম বাড়িতে।
তেহানি যাওয়ার সপ্তাহ খানেক পর এল জাহাজটা।
আগের রাতে হেইভা দেখে এসে ঘুমাতে ঘুমাতে মেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে সেদিন অনেক বেলা হয়ে যাওয়ার পরও ঘুম ভাঙেনি আমার। কাঁধে কারও স্পর্শ পেয়ে জেগে দেখি তুয়াহু। চেহারা দেখে মনে হলো কোন কারণে উত্তেজিত ও।
বিয়্যাম! রুদ্ধশ্বাসে বলল তুয়াহু, ওঠো! জাহাজ! জাহাজ!
আর শোনার জন্যে অপেক্ষা করলাম না। বিছানা থেকে নেমে ওর পেছন পেছন ছুটলাম সৈকতের দিকে।
এরই মধ্যে অনেক লোক জড়ো হয়েছে সেখানে। সবার দৃষ্টি পুর সাগরের দিকে। সূর্যের জন্যে, ভাল করে তাকাতে পারছে না, ভুরু কুঁচকে আছে। তুয়াহুর মত উত্তেজনায় টগবগ করছে তারাও।
স্পেনের জাহাজ হলে, একজনকে বলতে শুনলাম, এখানে আসবে।
ফ্রান্সের হলে হিটিয়ায় যাবে।
ব্রিটিশ হলে যাবে, মাতাভাই-এ, আমার দিকে তাকিয়ে যোগ কর তুয়াহু।
তোমার কি মনে হয়, ওটা ব্রিটিশ? জিজ্ঞেস করল আমার ফুফুশাশুড়ি টেতুয়াই।
কাধ ঝাঁকালাম আমি। এক ইন্ডিয়ান মন্তব্য করল, আর যা-ই হোক, স্পেনের না। দেখছ না দূর দিয়ে চলে যাচ্ছে।
নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলাম আমি। হা লোকটা ঠিকই বলেছে। এ দ্বীপে ভেড়ার কোন লক্ষণ নেই জাহাজটার গতিতে।
কিছুক্ষণ পর একটু যখন কুলের কাছাকাছি হলো, উপরের পালগুলোর আকৃতি দেখে আমার বুঝতে বাকি রইল না, ওটা ব্রিটিশ জাহাজই। বুকের ভেতর লাফিয়ে উঠল কলজেটা।
তুয়াহু! চিৎকার করলাম আমি, মনে হচ্ছে ওটা ব্রিটিশ.জাহাজ! তোমার ছোট ক্যানোটা নিয়ে তৈরি হও, এক্ষুণি আমরা মাতাভাই-এ যাব!
.
তেরো
মাতাভাই-এ পৌঁছেই আম্বি স্টুয়ার্টের সাথে দেখা করলাম।
আমি জানতাম তুমি আসবে, বলল ও। জাহাজটা কোথাকার বুঝতে পেরেছ?
হ্যাঁ, জবাব দিলাম। ইংল্যান্ডের যুদ্ধ জাহাজ।
আমারও তাই মনে হয়েছে, দুঃখ মেশানো স্বরে বলল স্টুয়ার্ট। খুশি হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু খুশি আসছে না। তোমার?
আমার অবস্থাও স্টুয়ার্টের মতই। জাহাজটাকে প্রথম দেখে সত্যিই খুশি হয়ে উঠেছিলাম, এবার দেশে ফিরতে পারব ভেবে। কিন্তু এর ভেতরে যে তাহিতিও আমার দেশ হয়ে উঠেছে তা বুঝতে পারলাম একটু পরেই, যখন মনে পড়ল তেহানির কুথা, আমার হেলেনের কথা। ইংল্যান্ডের সঙ্গে আমার বন্ধন যতটুকু তাহিতির সঙ্গে তার চেয়ে কম নয় মোটেই।
না, স্টুয়ার্ট, আমারও আসছে না, একটু চুপ করে থেকে আমি বললাম।
আমাদের বউ বাচ্চাদের কি হবে? করুণ, শোনাল স্টুয়াক্টের গলা। তোমার কাছে আশ্চর্য লাগতে পারে, বিয়্যাম, কিন্তু সত্যি বলছি, বাউন্টি চলে যাওয়ার পর একবারও আমার মনে হয়নি তাহিতি ছেড়ে যেতে হতে পারে আমাদের।
আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা। কিন্তু…
থাক, এ নিয়ে আর কথা বলে লাভ নেই। জাহাজটা ইংল্যান্ডের, তুমি ঠিক বুঝতে পেরেছ?
একদম ঠিক?
বেচারা মরিসন!
মানে?
মাত্র চারদিন আগে ও রওনা হয়ে গেছে ওর সেই ছোট্ট স্কুনার নিয়ে।
তাই নাকি! আর অন্যরা?
ওরাও গেছে। নরম্যান, ম্যাকইন্টশ, বায়ার্ন আর মুস্যাটকে নিয়ে ও বাতাডিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করবে। এলিসন, হিব্রান্ডট, বারকিট, মিলওয়ার্ড আর সামনারকে নামিয়ে দিয়ে যাবে কোন স্বপে।
মানে আগের পরিকল্পনা থেকে এক চুল নড়েনি ওরা।
হ্যাঁ।
বেচারাদের কপাল খারাপ বলতে হবে। আর মাত্র চারটে দিন যদি থেকে যেত…
এই সময় জোর এক হৈ-চৈ উঠল সৈকতে ভীড় করে থাকা ইন্ডিয়ানদের ভেতর। দেখতে পেয়েছে ওরা জাহাজটাকে। ছোট্ট একটা অন্তরীপের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে আসছে মাতাভাইয়ের দিকে। এখনও ওটা উপকূলের তিন চার। মাইল দূরে রয়েছে। এদিকে সন্ধ্যা হয় হয়। বাতাসের বেগ কমে গেছে। আজ আর ওটা বেশিদূর এগোতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।
হ্যাঁ, ঠিক তাই। একটু পরেই দেখলাম একে একে পালগুলো গুটিয়ে ফেলা হলো জাহাজটার। এতদূর থেকে আমরা দেখতে না পেলেও বুঝলাম নোঙ্গরও ফেলা হয়েছে। একে একে লোকজন ফিরে যেতে লাগল যার যার বাড়িতে। যারা একটু বেশি উৎসাহী তারা রয়ে গেল সৈকতে।
রাতটা আমি স্টুয়ার্টের বাড়িতে কাটালাম।
পরদিন ভোরে সূর্য ওঠার আগেই ফিরে এলাম সৈকতে তুয়াহু আর টাউতিরা থেকে অন্য যারা এসেছে তাদের কাছে। ওরা সৈকতেই রাত কাটিয়েছে। তুয়াহু ক্যানো নিয়ে জাহাজের কাছে যাওয়ার প্রস্তাবদল। ও বলল, জাহাজটা যদি অপরিচিত হয়, আমরা পথ দেখিয়ে নিয়ে আসলে ক্যাপ্টেন খুশি হবে। আর যদি ওটা পারাই-এর জাহাজ হয় আমরাই প্রথম এর সাথে দেখা করব।
আপত্তি করার কিছু দেখলাম না। একটু পরেই ক্যানোয় চেপে রওনা হয়ে গেলাম আমরা-আমি, তুয়াহু, আর তুয়াহুর বৃদ্ধ ভৃত্য পাওটো।
ঘন্টা খানেক লাগল জাহাজটার কাছে পৌঁছুতে। ইতোমধ্যে সূর্যোদয় হয়েছে। দূর থেকে দেখলাম জাহাজটার গায়ে বড় বড় হরফে লেখা প্যানডোরা। কিছুক্ষণ আগে নোঙ্গর তুলে রওনা হয়েছে ওটা। আমরা যখন মাত্র কয়েকশো গজ দূরে তখন প্যানডোরার নাবিকরা লক্ষ করল আমাদের। জাহাজের মুখ সামান্য ঘুরিয়ে আমাদের ক্যানোর দিকে আসতে লাগল ওরা।