বাউন্টির মত ছোট জাহাজে চল্লিশজন সঙ্গীসহ মাঝ সাগরে নোঙ্গর ফেলা অবস্থায় দিনের পর দিন চুপচাপ কাটিয়ে দেয়া সোজা কথা নয়। দুদিন যেতে না যেতেই বিরক্ত হয়ে উঠল সবাই। আমার ব্যাপারটা অবশ্য অন্যরকম। জাহাজ চালানোর কায়দা কানুন শিখতে শিখতে কোন দিক দিয়ে যে দিন কেটে যায়। আমি টের পাই না। লেফটেন্যান্ট ব্লাই নিজে শেখাচ্ছেন ত্রিকোণমিতি আর নৌ জ্যোতির্বিদ্যা। পাল খাটানো, দড়িদড়ার ব্যবহার, নোঙ্গর ওঠানো নামানো শিখছি মাস্টার ফ্রায়ার এবং মাস্টারের মেট ক্রিশ্চিয়ানের কাছে। সারেং উইলিয়াম কোল আর তার সহকারী জেমস মরিসনের কাছে শিখছি জাহাজ চালানোর কৌশল।
একটানা চব্বিশ দিন আবহাওয়া খারাপ থাকার পর বাইশ ডিসেম্বর বিকেলে আকাশ পরিষ্কার হলো। দিক বদলে বাতাস বইতে লাগল পুব মুখে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচল নাবিকরা। অলস দিনের অবসান হলো বোধহয়।
পরদিন ভোরে সারেং-এর শিঙার আওয়াজ আর মরিসনের চিৎকার শুনে যখন ঘুম ভাঙল তখনও রাতের আঁধার কাটেনি। ঝটিতি ডেকে এসে দেখি, বেশির ভাগ নাবিক পৌঁছে গেছে যার যার জায়গায়। ঠাণ্ডা কনকনে বাতাস বেশ জোরে বইছে ফরাশি উপকূলের দিক থেকে। মাস্টার ফ্রায়ার ও সহকারী মাস্টার ক্রিশ্চিয়ানকে নিয়ে কোয়ার্টার ডেকে দাঁড়িয়ে আছেন লেফটেন্যান্ট ব্লাই। নোঙ্গর তোলার কাজে ব্যস্ত কয়েকজন খালাসী।
উপরের পালগুলো ঢিলে করে দাও! ফ্রায়ারের নির্দেশ শুনতে পেলাম।
আমার কাজের জায়গা নিদিষ্ট হয়েছে পেছনের মাস্তুলের ওপরে। মাস্টারের নির্দেশ শুনে তাড়াতাড়ি উঠতে শুরু করলাম আমি। ওপরে উঠে দেখি কয়েকজন নাবিক আগেই পৌঁছে গেছে সেখানে। চামড়ার যে লম্বা খাপের ভেতর পাল মুড়ে রাখা হয় সেটার মুখ খোলার জন্যে টানা হ্যাঁচড়া করছে ওরা। চামড়ার বাধনীগুলো হিমে জমে গেছে। সহজে খুলতে চাইছে না। সেজন্যেই এই টানা হ্যাঁচড়া। এদিকে দেরি দেখে নিচ থেকে ব্লাই চিৎকার করে উঠেছেন:
করছ কি তোমরা, আঁ? ঘুমিয়ে গেছ নাকি? এতক্ষণ লাগে ওইটুকু একটা পাল খুলতে।
অবশেষে খুলল ছোট পালটা। বাতাস লেগে ফুলে উঠল। মৃদু একটু ঝাঁকুনি খেলো বাউন্টি। ইতোমধ্যে নোঙ্গর তোলা হয়ে গেছে। চলতে শুরু করল জাহাজ।
ক্যাপ্টেনের নির্দেশে একে একে অন্য পালগুলোও মেলে দেয়া হলো।
বড় পালটা একটু ঘুরিয়ে দাও! রাই-এর নির্দেশ শোনা গেল। বাতাসের দিকে। হ্যাঁ, হয়েছে! সামনের মাস্তুলের ছোট পালটা সোজা করে দাও।
এমনি ধরনের আদেশ নির্দেশ চলতে লাগল। সেই সাথে খালাসীদের, নাবিকদের দড়িদড়া টানাটানির সময়, হেইও হো! হেইও হো! চিৎকার।
ধীরে ধীরে স্বচ্ছন্দ হয়ে এল বাউন্টির গতি। চিৎকার চেঁচামেচি কমতে কমতে থেমে গেল একসময়। জাহাজ এগিয়ে চলল খোলা সাগরের দিকে।
নির্মেঘ আকাশে সূর্য উঠল। চমৎকার শীতের সকাল। স্বচ্ছ, ঠাণ্ডা, ঝলমলে। মাস্তুলের মাথা থেকে নেমে এসেছি কিছুক্ষণ আগে। এখন দাঁড়িয়ে আছি রেলিং-এ হেলান দিয়ে। ঝুঁকে পড়ে দেখছি সাগরের লোনা জল কেটে বাউন্টির এগিয়ে যাওয়া।
.
সেদিনই সন্ধ্যায় বাতাস বাড়তে বাড়তে ঝড়ের রূপ নিল। বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল সাগর। কিন্তু পরদিন ভোর হতে না হতেই আবার আগের মত শান্ত। যেন আমাদের ক্রিস্টমাস উদযাপনের সুযোগ দেয়ার জন্যে ঝড় এসেও এল না। চব্বিশ তারিখ মধ্যরাত থেকেই উৎসবের আমেজ লাগল বাউন্টিতে। ক্যাপ্টেনের নির্দেশে অতিরিক্ত মদ সরবরাহ করা হলো। পরদিন দুপুরে বিশেষ ভোজের ব্যবস্থা হলো।
জাহাজী বন্ধুদের সাথে আমার জানা-শোনার পর্ব চলছে এখনও। একটু একটু করে অপরিচিত লোকগুলো সব আপন হয়ে উঠছে। নিচের ডেকে একটা বার্থে থাকতে দেয়া হয়েছে আমাকে। হেওয়ার্ড, স্টুয়ার্ট আর ইয়ংও থাকে একই বার্থে। আমার খাওয়ার ব্যবস্থাও ওই তিনজনের সাথে মেস করে। চারজন রাতে শোয়ার জন্যে ব্যবহার করি চারটে হ্যামক। দিনে বড় একটা সিন্দুককে বানাই খাওয়ার টেবিল; ছোট ছোট কয়েকটা বাক্স কাজ করে চেয়ারের। এক জায়গায় ঘুমাই এবং খাই বলে স্বাভাবিক ভাবেই এই তিনজনের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা অন্যদের চেয়ে একটু বেশি হয়েছে।
খালাসী মাইকেল বায়ার্ন চমৎকার বাঁশি বাজায়। লোকটা প্রায় অন্ধ। কি করে যেন ও ওর এই অন্ধতু সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিল। বাউন্টি গভীর সমুদ্রে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত কেউ টের পায়নি। যখন পেল তখন আর ওকে তীরে রেখে আসার উপায় নেই। ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ার পর ভীষণ রেগে গেলেন মিস্টার ব্লাই। পারলে তখনই ছুঁড়ে ফেলে দেন সাগরে। অন্য নাবিকরাও খেপে গেল। কিন্তু লাভ কি খেপলে? জ্যান্ত একজন মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় কি সাগরে ফেলে দেয়া সম্ভব? প্রথমদিন রাতে ডেকের ওপর যখন খালাসীরা হল্লা করতে করতে মদ খাচ্ছে তখন আপন মনে কঁশিটা বের করে জনপ্রিয় এক লোকগীতির সুর তুলল বায়ার্ন। মুহূর্তে থেমে গেল সব হৈ চৈ। মগে চুমুক দিতেও যেন ভুলে গেল সবাই। যতক্ষণ বায়ার্ন বাঁশি বাজাল একটা শব্দ করল না লোকগুলো। বাঁশি শেষ হতে সব এক সাথে এসে ঘিরে ধরল ওকে। ওর ওপর আর বিদ্বেষ রইল না কারও। ওর যে অন্ধত্ব ছিল ক্রোধের কারণ তা হয়ে উঠল সহানুভূতির ব্যাপার।
ক্রিসমাসের পর দিন আবার ঝড় এল। এবার আরও তীব্রতা নিয়ে। ঝড়ের শুরুতেই বিরাট এক ক্ষতি হয়ে গেল আমাদের। বিয়ারের বড় বড় কয়েকটা পিপে ভেসে গেল পানিতে। পিপেগুলো ডেকের এক পাশে রাখা ছিল। বিশাল এক ঢেউ যখন বাউন্টির ওপর ভেঙে পড়ে তখন ওগুলোর কয়েকটা ভেসে যায় সাগরে। জাহাজের তিনটে নৌকাও আরেকটু হলে দড়ির বাঁধন ছিঁড়ে ভেসে যাচ্ছিল। কয়েকজন খালাসীর চেষ্টায় বেঁচে যায় ওগুলো। বাউন্টির সম্বল বলতে ওই সিটে নৌকা। ভেসে গেলে কি যে হত বলা মুশকিল। হয়তো ওই দিনই ফিরতি পথে রওনা হতে হত আমাদের। নৌকা ছাড়া দক্ষিণ সাগরের দ্বীপগুলোয় অবতরণ এক কথায় অসম্ভব।