পনেরো দিন পর এই ঘটনার সমাপ্তি টানল নিয়তি।
আমি আর তেহানি টাউতিরায় ফিরে দেখি চার্চিল আর থম্পসন হাজির সেখানে। তাহিতিতে ফিরে যাওয়ার সাহস পায়নি ওরা। তাইয়ারাপুতে কয়েকদিন কাটিয়ে তাই চলে এসেছে টাউতিরিয়ায়। ভেহিয়াটুয়া আমার বন্ধু ভেবে মোটামুটি সাদরেই গ্রহণ করেছে ওদের। ইতোমধ্যে থম্পসনের ওপর চরম বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেছে চার্চিলের মন। এককালে লোকটা ওর সাথী, ছিল, ভেবে ও ওকে না পারছে গিলতে না পারছে ওগরাতে।
আমরা যেদিন পৌঁছুলাম সেদিনই চার্চিল এল আমাদের বাড়িতে। হাতে মাঙ্কেট। অনেকক্ষণ কথাবার্তার পর থম্পসনের প্রসঙ্গ উঠতেই ও বলল, বদমাশটাকে খুন করার কথা ভেবেছি বহুবার। প্রতিবারই শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গেছি। ঠাণ্ডা মাথায় একজনকে খুন করি কি করে, তুমিই বলো! এখন আফসোস হয়, কেন যে সেদিন ওকে বাঁচাতে গেলাম ইন্ডিয়ানদের হাত থেকে!
হুঁ। না হলে সেদিনই ওর দফা রফা হয়ে গিয়েছিল, আমি বললাম।
খুবই ভাল কাজ হত একটা! একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি আমি। আজ ওকে বলে দিয়েছি, ক্যানোটা নিয়ে যেখানে খুশি চলে যাক, আর যেন এখানে না ফেরে।
শোনো, তুমি আর ওকে নিয়ে মাথা ঘামিও না, ইন্ডিয়ানরাই যা করার করবে। তুমি সঙ্গে না থাকলে এতদিন কবে ওকে সাবড়ে দিত!
জানি। তুমি একটু সাবধানে থেকো, বিয়্যাম। আমার ধারণা ও উন্মাদ হয়ে গেছে; কখন কি করে বসে ঠিক নেই। তোমার কাছে তো একটা মাস্কেট আছে, তাই না? সব সময় ওতে গুলি ভরে রেখো। যতদিন না বদমাশটা এখন থেকে যাচ্ছে ততদিন একটু সতর্ক থাকাই ভাল।
সেদিনই রাতে। আমার বন্ধুদের সম্মানে এক হেইভার আয়োজন করেছে আমার চাচাশ্বশুর। হেইভা মানে অনেকদিন আগে টেতিয়ারোয়ায় যে অনুষ্ঠানে তেহানিকে-নাচতে দেখেছিলাম সে ধরনের অনুষ্ঠান। এক পাশে তেহানি অন্য পাশে চার্চিলকে নিয়ে সবুজ ঘাসের গালিচায় বসেছি আমি। ঢাকের আওয়াজ সবে শুরু হয়েছে কি হয়নি অমনি ইন্ডিয়ান ভাষায় পেছন থেকে কয়েকজনের চিৎকার শুনতে পেলাম, দেখো! দেখো! সাবধান! তারপরই গুলির শব্দ। চার্চিল লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াতে গেল। কিন্তু তার আগেই গলা দিয়ে কাশির মত একটা আওয়াজ করে লুটিয়ে পড়ল আমার পাশে। মাস্কেটটা খসে পড়ল ওর হাত থেকে।
নারী কন্ঠে তীক্ষ্ণ চিৎকার, আর পুরুষদের হাঁকডাকে ভরে গেল জায়গাটা। সব শব্দ ছাপিয়ে ভেহিয়াটুয়ার গলা শুনতে পেলাম: এই! মারো ওকে! মারো ওকে! মশালের আলোয় দেখলাম মাস্কেট হাতে ছুটে সৈকতের দিকে পালাচ্ছে থম্পসন। দর্শকদের ভেতর ছিল আতুয়ানুই নামের এক দুর্ধর্ষ বীর। বিরাট একটা পাথর দুহাতে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিল সে আততায়ীকে লক্ষ্য করে। থম্পসনের দুকাঁধের মাঝখানে লাগল সেটা। মুখ থুবড়ে পড়ে গেল থম্পসন। পর মুহূর্তে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আতয়ানুই। সেই পাথরটাই আবার তুলে নিয়ে আঘাত করে চলল একের পর এক। খুলি ফেটে ঘিলু বেরিয়ে এল থম্পসনের।
তেহানির হাত ধরে আমি যখন বাড়ি ফিরছি, তখন চার্চিলও আর বেঁচে নেই।
.
সতেরোশো নব্বই সালের ১৫ আগস্ট আমাদের মেয়ে হেলেন-এর জন্ম হলো। দীর্ঘ পদবীসহ তেহানির নামে নাম রাখা হলো তার। আমি আমার মত করেও একটা নাম রাখলাম-আমার মায়ের নামে। নিজের মেয়ে বলে বলছি না, সত্যিই অদ্ভুত সুন্দর হয়েছে বাচ্চাটা। মোটাসোটা স্বাস্থ্যবান। চোখ দুটো অপূর্ব, গাঢ় নীল, সাগরের মত। আমাদের প্রথম বাচ্চা অর্থাৎ মাতাহিয়াপো বলে ওর জন্ম তাইয়ারাপুর জন্যে এক বিশেষ ঘটনা। শুধু ধর্মীয় বা সামাজিক দিক থেকেই নয়, রাজনৈতিক দিক থেকেও।
ভেহিয়াটুয়ার পারিবারিক মন্দিরের পেছনে বড় একটা জায়গা বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। তিনটে ছোট ছোট ঘর তৈরি করা হয়েছে তার ভেতর। প্রথমটার নাম মিষ্টি ফানৈর ঘর এই ঘরে প্রসূতি সন্তান প্রসব করে। দ্বিতীয়টাকে বলা হয় আঁতুড় ঘর। প্রসবের পর পনেরোদিন মা ও শিশু এখানে থাকে। তৃতীয় ঘরের নাম সাধারণ ঘর। এখানে থাকে প্রসূতির সেবিকারা।
ছোট্ট হেলেন জন্ম নেয়ার পর ছদিন পর্যন্ত আমাকে যেতে দেয়া হলো না ওর কাছে। এরকমই নাকি রীতি এখানকার। সপ্তম দিন সকালে আমাকে নিয়ে রওনা হলো ভেহিয়াটুয়া। গণ্ডী পেরিয়ে ঢুকলাম দুজন আঁতুড়, ঘরে। প্রথমবারের মত আমি আমার মেয়ের মুখ দেখলাম। ছোট্ট হাতের মুঠো দুটো নাড়ছে আমার দিকে তাকিয়ে।
.
দেখতে দেখতে চলে গেল বছরটা। আমার মেয়ের বয়স এখন সাত মাস। তেহানি আর হেলেনকে নিয়ে সুখেই কাটছে আমার জীবন টাউতিরায়। দেশের কথা ভুলতে বসেছি। মাঝে মাঝে যেটুকু মনে পড়ে তার পুরোটা জুড়ে থাকে মা। মাস তিনেক আগে স্টুয়ার্ট আর পেগি এসেছিল আমাদের এখানে বেড়াতে। ওদেরও একটা মেয়ে হয়েছে। আমাদের হেলেনের মতই ফুটফুটে সুন্দর। দুতিন দিন থেকে ফিরে গিয়েছিল ওরা। আমার অভিধানের কাজ চলছে। এ এমন এক কাজ যার শেষ বোধহয় কখনোই হবার নয়-অন্তত একজনের জীবনকালে যে নয় তাতে আমি নিঃসন্দেহ। প্রতিদিনই নতুন নতুন শব্দের সন্ধান পাচ্ছি, লিপিবদ্ধ করছি; কখনও কোন বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কোন পুরানো শব্দের নতুন ব্যঞ্জনা খুঁজে পাচ্ছি। এছাড়া ঘরে। কাজ তো আছেই। মেয়ের পরিচর্যায় তেহানিকে সুযোগ পেলেই সাহায্য করি। সব মিলিয়ে সময় এখন কোন দিক দিয়ে যে পেরিয়ে যায় টেরই পাই না।