ওতে চড়ে বাতাভিয়ায় পৌঁছানোর আশা করো তুমি?
হ্যাঁ। বাতাভিয়ায় একবার পৌঁছুতে পারলে হয়, কোন ডাচ জাহাজে জায়গা পেয়ে যাব নিশ্চয়ই। আমরা পাঁচজন যাব-নরম্যান, ম্যাকইশ, মুস্যাট, বায়ার্ন আর আমি। স্টুয়ার্ট আর কোলম্যান এখানেই থাকতে চায় যতদিন না ইংল্যান্ড থেকে জাহাজ আসে।
আমারও তাই ইচ্ছা, আমি বললাম। টাউতিরায় ভালই আছি। মন দিয়ে অভিধানের কাজ করতে পারছি।
আমার কথা যদি জিজ্ঞেস করো, স্টুয়ার্ট বলল, বাস করার জায়গা হিসেবে মন্দ নয় তাহিতি। এ জায়গা ছেড়ে জবে মরার কোন ইচ্ছা আমার নেই।
ডুবে মরা না আরও কিছু! মরিসন বলল। আমাদের এই ছোট্ট স্কুনার সারা দুনিয়া ঘুরে আসতে পারবে, দেখো!
আমাদের কথা তো বললেন না মিস্টার বিয়্যামকে, বলে উঠল এলিসন। ছোট একটা রাজ্য গড়ে তুলতে যাচ্ছি আমরা। মিস্টার মরিসন, কথা দিয়েছেন এখানকার পশ্চিমে কোন দ্বীপে আমাদের নামিয়ে দিয়ে যাবেন।
হ্যাঁ, মরিসন বলল, সেটাই সবচেয়ে ভাল হবে ওদের জন্যে। শান্ত, নিরীহ লোকজন বাস করে এরকম একটা দ্বীপ ওদের খুঁজে দেয়ার চেষ্টা করব।
ওদের মানে, বিদ্রোহীদের? সবাই নাকি? জিজ্ঞেস করলাম।
সবাই না। টম ছাড়া, মিলওয়ার্ড, বারকিট, হিব্রান্ডট আর সামনার যাবে। চার্চিল স্কিনার এখানেই থেকে যাবে ঠিক করেছে।
আর থম্পসন?
ওর কথা বোলো না, একটা জানোয়ার। যা ইচ্ছা হয় করবে, আমার জাহাজে ওর জায়গা হবে না।
মানে?
মানে এখানে যদি কদিন থাকে নিজেই টের পাবে।
পরদিনই টের পেলাম।
.
ভোরবেলা সৈকতে গেছি সাগরে স্নান করব বলে। ডাঙায় তোলা একটা ক্যানোর পাশে দেখলাম ওকে। সঙ্গে আছে চার্চিল। বাচ্চা একটা শুয়োর আগুনে ঝলসাচ্ছে, নাশতা করবে বলে। আমাকে দেখেই খুশি হয়ে উঠল চার্চিল। আন্তরিক গলায় বলল, এসো, বিয়্যাম, নাশতা করো আমাদের সাথে।
তুমি একটা উজবুক, চার্চিল! গর্জে উঠল থম্পসন। নিজেদেরই হয় না, এর ভেতর আবার ডাকছ বদমাশটাকে!
মুহূর্তে আগুন হয়ে উঠল চার্চিল। তুমি-তুমি একটা নরকের কীট! বলল সে। মিস্টার বিয়্যাম আমার বন্ধু। যাও ওই আধা সভ্য ইন্ডিয়ানগুলোর কাছে শিখে এসো, বন্ধুর সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয়!
আর একটা কথাও না বলে থম্পসন উঠে একটা বালিয়াড়ির ওপর গিয়ে বসল। দুহটুর মাঝখানে খাড়া করে রাখল মাস্কেট।
এমনিতে আমার নাশতা করার সময় এখনও হয়নি তার ওপর যে ঘটনা ঘটে গেল তাতে ওদের খাবারে ভাগ বসাবার প্রশ্নই ওঠে না। চার্চিলকে ধন্যবাদ জানিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি দশ বারো জন লোক বড়সড় একটা পালতোলা ক্যানো ডাঙায় টেনে তুলছে। ক্যানোর মালিক ও তার স্ত্রী এগিয়ে আসছে। আমাদের দিকে। লোকটার কোলে তিন চার বছরের একটা বাচ্চা। চার্চিল আর থম্পসনের ক্যানোটার কাছে পৌঁছে দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা। মহিলা কৌতূহলী হয়ে একটু কুঁকল সাদা মানুষদের ক্যানোয় কি আছে দেখার জন্যে। অমনি শোনা হেলি থম্পসনের কর্কশ চিৎকার;
সরো! সরো ওখান থেকে!
বিনীত ভঙ্গিতে মুখ তুলল ইন্ডিয়ান দম্পতি। থম্পসনের ইংরেজি কথার কিছুই বুঝতে পারেনি ওরা।
সরে যা ওখান থেকে, গর্দভের দল! আবার চেঁচাল থম্পসন, এবং এবারও ইংরেজিতে।
অসহায়, একটু বিস্মিত চেহারা হলো ইন্ডিয়ান দম্পতির। কি করবে বুঝতে পারছে না। চার্চিল মাত্র মুখ খুলেছে ওদের বুঝিয়ে বলার জন্যে, এই সময় আচমকা মাস্কেট তুলে গুলি করে বসল থম্পসন। বাচ্চা এবং তার বাবার বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেল শুলি। দুজনই লুটিয়ে পড়ল বালুকাবেলায়। লাল হয়ে উঠল মাটি। বাচ্চার মা আর্তনাদ করে উঠল প্রাণ কাঁপানো স্বরে। চারপাশ থেকে মানুষজন ছুটে আসতে লাগল আমাদের দিকে।
লাফ দিয়ে উঠে থম্পসনের কাছে ছুটল চার্চিল। এক ঘুষিতে খুনীটাকে শুইয়ে ফেলল মাটিতে। মাস্কেট কেড়ে নিল। তখনও ধোঁয়া বেরুচ্ছে সেটার নল দিয়ে। এরপর আর এক মুহূর্ত দেরি না করে থম্পসনের জ্ঞানহীন দেহটা কাঁধে তুলে নিয়ে ছুটে গেল নিজেদের ক্যানোর দিকে! খোলের ভেতর থম্পসনকে নামিয়ে রেখে ক্যানোটাকে টেনে নামিয়ে ফেলল সাগরে। কেউ কি ঘুটছে ভাল করে বোঝার আগেই সে পাল তুলে দিল। কিছুক্ষণের ভেতর পশ্চিম দিকে হারিয়ে গেল ক্যানোটা।
মৃত্যু পথযাত্রী বাবা ও বাচ্চার কাছে ছুটে গেলাম আমি। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে তখন। মৃত্যুর কোলে আশ্রয় পেয়েছে দুজনই। ততক্ষণে দলে দলে ইন্ডিয়ান জড়ো হতে শুরু করেছে সাগর অরে। মৃতদেহ দুটো দেখে ভয়ানক হয়ে উঠেছে তাদের চেহারা। কয়েকজন হাতে তুলে নিয়েছে পাথরের টুকরো, কারও কারও হাতে লাঠি। দুতিন জন ছুটে এসে ধরে ফেলল আমাকে। এই সময় যেন মাটি খুঁড়ে উদয় হলো হিটিহিটি।
ও আমার তাইও! গম্ভীর কণ্ঠে সে বলল, ছেড়ে দাও ওকে! ও কোন অপরাধ করেনি। তোমরা মেয়ে মানুষের মত জটলা করছ কেন এখানে? হাতে অস্ত্র আছে, ক্যানো ভাসিয়ে ধাওয়া করে ধরো না খুনীদের! যে খুন করেছে, তাকে আমি চিনি, কোন ইংরেজ ওকে বাঁচানোর জন্যে হাত তুলবে না!
এতক্ষণে যেন লোকগুলো বুঝতে পারল কি করতে হবে। ক্যানো ভাসিয়ে ছুটল ওর চার্চিল ও থম্পসনের পেছন পেছন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দূর চলে গেছে চার্চিলের ক্যানো। প্রাণপণ চেষ্টা করেও ধরতে পারল না ওরা।