এই নারী কিছুক্ষণের ভেতর তোমার স্ত্রী হবে, গম্ভীরকণ্ঠে সে বলল। মনে রেখো, ও নারী, দুর্বল। সাধারণ মানুষ ক্রোধের বশে স্ত্রীকে আঘাত করতে পারে, গোত্রপতিদের তা সাজে না। ওর সাথে সদয় ব্যবহার করবে, মানিয়ে চলবে। থামল তাওমি। তারপর তেহানির দিকে ফিরে বলে চলল, এই পুরুষ কিছুক্ষণের ভেতর তোমার স্বামী হবে। মনে রাখবে, ক্রোধের সময় জিহ্বাকে সংযত করা, ধৈর্য ধরা তোমার কর্তব্য হবে। ওর মঙ্গলের দিকে নজর রাখবে, অসুস্থ হলে সেবা করবে, যুদ্ধে আহত হলে ক্ষত সারিয়ে তুলবে। প্রেমই বিবাহের খাদ্য। তোমাদের বিবাহকে অভুক্ত রেখো না। একটু থেমে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আবার সে বলল, এ মাইতাই ইয়া মাই তে মেআ রা এ এ না রেইবা ওরুআ অর্থাৎ, এভাবে যদি তোমরা চলো, তোমাদের মঙ্গল হবে।
কথাটা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলাম, আমার হাতের ভেতর কেঁপে উঠল তেহানির হাত। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম, ওর চোখে জল। গভীর নিস্তব্ধতা মন্দিরে। ভেহিয়াটুয়ার গৃহদেবতা তাওরার উদ্দেশ্যে আমাদের মঙ্গল কামনা করে দীর্ঘ প্রার্থনা করল পুরোহিত। তারপর বলল, তাপোইটা নিয়ে এসো!
তাপোই হচ্ছে পুরুষদের তৈরি বাদামী রঙের এক ধরনের কাপড়। এই কাপড়কে পবিত্র বলে গণ্য করা হয় ইন্ডিয়ান সমাজে।
মন্দিরের পেছন থেকে বিরাট কাপড়টা নিয়ে এল এক মন্দির রক্ষক। পুরোহিত সেটা দুহাতে ধরে মেলে নিল প্রথমে। তারপর আচমক ছুঁড়ে দিল আমাদের ওপর। আমি আর তেহানি সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে গেলাম ওটার নিচে। এক মুহূর্ত পরেই সরিয়ে নেয়া হলো তাপোই। উঠে দাঁড়াতে বলা হলো আমাদের। বিয়ে শেষ। আমি আর তেহানি এখন বর ও বধূ। দুই পরিবারের সদস্যরা একে একে এগিয়ে এসে ইন্ডিয়ান রীতিতে আলিঙ্গন করতে লাগল আমাদের।
.
বারো
বিয়ের এক মাস পর তেহানি আর আমি বেড়াতে এলাম আমার তাইওর বাড়িতে। বুড়ো হিটিহিটিকে, সেই সাথে স্টুয়ার্ট, মরিসন এবং বাউন্টির অন্য নাবিক বন্ধুদের দেখার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলাম মনেমনে।
মরিসন আর মিলওয়ার্ড সেই নামকরা যোদ্ধা পইনোর বাড়িতে থাকে এখন। স্টুয়ার্ট পেগিকে বিয়ে করেছে। পেগির বাবা টিপাউ-এর বাড়িতেই আছে ওরা। অন্যরাও যার যার সুবিধা ও সুযোগ মত থাকার জায়গা ঠিক করে নিয়েছে।
দুপুর নাগাদ আমরা পৌঁছুলাম হিটিহিটির বাড়িতে।
তোমার বন্ধুরা জাহাজ তৈরি করছে, খাওয়ার সময় হিটিহিটি জানাল। মরিসন আর মিলওয়ার্ড তদারক করছে কাজ। তলী বসানো হয়ে গেছে, এখন ওরা খোল জুড়ছে।
আমি খুব একটা অবাক হলাম না, মরিসন আগেই জানিয়েছিল ছুতোর মিস্ত্রীর দুই সহকারীকে নিয়ে জাহাজ অর্থাৎ বড়সড়, সাগরপাড়ি দেয়ার উপযোগী নৌকা বানানোর চেষ্টা সে করবে! আমার যা হলো, তা কৌতূহল। দিবানিদ্রা শেষ করে হাঁটতে হাঁটুতে আমরা গেলাম সেখানে, যেখানে জাহাজ তৈরি হচ্ছে–হিনা, ওর বাবা, তেহানি আর আমি।
সৈকত থেকে শখানেক গজ দূরে এক টুকরো ঘাসে ছাওয়া জমি পছন্দ করেছে মরিসন একাজের জন্যে। জমিটার মালিক মহা-গোত্রপতি টেইনা। একদল ইন্ডিয়ান বসে বসে দেখছে সাদা মানুষদের কাজ। গভীর কৌতূহল ওদের চোখে মুখে। আমরা যখন পৌঁছুলাম তখন, টেইনা স্বয়ং তার স্ত্রী ইটিয়াকে নিয়ে উপস্থিত সেখানে। সহৃদয়তার সাথে আমাদের অভ্যর্থনা জানাল ওরা। আমার ওপর চোখ পড়তেই হাতের কাজ ফেলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে এগিয়ে এল মরিসন।
তোমার বিয়ের খবর শুনেছি, আমার সাথে করমর্দন করতে করতে সে বলল। কামনা করি, তোমরা সুখী হও।
তেহানির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম ওর। এই সময় লাফাতে লাফাতে এল ছোকরা টম এলিসন। কেমন দেখলেন আমাদের জাহাজ, মিস্টার বিয়্যাম? জিজ্ঞেস করল সে। মাত্র ত্রিশ ফুট লম্বা যদিও, তবু মিস্টার মরিসন আশা করছেন ওতে চড়ে আমরা বাতাভিয়ায় পৌঁছুতে পারব।
আমিও তাই আশা করি, একটু হেসে আমি বললাম।
জাহাজ বানানোর কাজে অন্য যারা অংশ নিচ্ছে তাদের সাথে কুশল বিনিময় হলো এরপর। বাউন্টির আর্মারার কোলম্যান, ছুতোর মিস্ত্রীর দুই সহকারী নরম্যান আর ম্যাকইন্টশ, খালাসী হিল্যান্ডট, ডিক স্কিনার-সবার সাথেই কিছু না কিছু আলাপ করলাম। একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম, এরা সবাই কাজ করছে প্রাণের তাগিদে। কেউ কেউ সত্যি সত্যি ইংল্যান্ডে ফিরতে চায় বলে, বাকিরা ইংল্যান্ড থেকে আরেকটা জাহাজ এসে পড়ার আগেই এই ছোট্ট জাহাজে উঠে পাল তুলে দিতে না পারলে কি পরিণতি হবে তা ভেবে।
আন্তরিক ভাবে ওদের কাজের সাফল্য কামনা করে বিদায় নিলাম আমরা। তারপর গেলাম স্টুয়ার্টের বাড়িতে। আমরা যখন পৌঁছুলাম ও তখন শ্বশুরের বাগানে কাজ করছে। আমাদের দেখেই কাজ ফেলে উঠে এল স্টুয়ার্ট, চিৎকার করে ডাকাডাকি করতে লাগল পেগিকে। তেহানির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম ওদের।
রাতে আমাদের এখানে খাচ্ছ তোমরা, ঘোষণা করল স্টুয়ার্ট। খুশি মনেই আমরা নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। মরিসন আর এলিসন এসেছে আমাদের সাথে। ওদেরও খেয়ে যেতে বলল স্টুয়ার্ট।
কতদিন লাগবে তোমাদের জাহাজ তৈরি শেষ হতে? খেতে খেতে আমি জিজ্ঞেস করলাম মরিসনকে।
আরও ছমাস তো লাগবেই, বেশিও লাগতে পারে। যন্ত্রপাতি এত কম, দ্রুত কাজ করতে পারছি না।