এটা? তেহানির কাঁধ ধরে আমি বললাম!
ভাল বলেছ, হেসে বলল মহা-গোত্রপতি। সত্যিই রাজসিক উপহার। ভাল করে দেখ তো, এখানকার কোন দ্বীপে ওর জুড়ি খুঁজে পাবে?
.
পরদিনই আমি ভেহিয়াটুয়ার সাথে তল্পিতল্পাসমেত চলে এলাম টেতিয়ারোয়ায়। হিটিহিটি ও তার মেয়ে এল পরদিন। তার পরদিন শুরু হলো তেহানির সাথে আমার বিয়ের অনুষ্ঠানাদি।
প্রথমেই সাগর তীরে মক্কার একটা নতুন বাড়ি আমাকে উপহার দিল ভেহিয়াটুয়া। ওর নিজের বাড়ি থেকে সেটার দূরত্ব খুব বেশি হলে এক কেবল (১ কেবল=১০০ ফ্যাদম বা ৬০০ ফুট বা ১/১০ নটিক্যাল মাইল)। সেই দিনই আমি আমার নতুন বাড়িতে উঠে গেলাম হিটিহিটি, হিনা, হিনার স্বামী আর ওদের সাথে তাহিতি থেকে যারা এসেছে তাদের সবাইকে নিয়ে। পরদিন ভোরে সদলবলে ভেহিয়াটুয়ার বাড়ির পথে রওনা হলাম আমরা, সঙ্গে বিপুল পরিমাণ উপহার সামগ্রী। আনুষ্ঠানিক ভাবে ওগুলো গ্রহণ করল ভেহিয়াটুয়ার পরিবার। এরপর দুই পরিবারের সদস্যরা যৌথভাবে মিছিল করে এল আমার বাড়িতে। মিছিলের পেছনে এল ভূত্যের দল, কনের বাপের বাড়ি থেকে দেয়া উপহার সামগ্রী নিয়ে। সেসব উপহারের ভেতর আছে গৃহপালিত জন্তু থেকে শুরু করে কাপড়, মাদুর, আসবাবপত্র-মোট কথা নতুন একটা সংসার শুরু করতে যা যা লাগে সর।
ঘরে ফিরে হিনা-যে এখন আমার পরিবারের কর্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছে-বিরাট একটা নতুন মাদুর বিছিয়ে দিল। তার ওপর পাতা হলো নতুন একটা সাদা চাদর। ভেহিয়াটুয়ার স্ত্রী নেই। তার বড় বোন টেতুয়ানুই পালন করছে তার পরিবারের কর্ত্রীর দায়িত্ব। টেতুয়ানুই হিনার চাদরটার ওপর বিছিয়ে দিল আর একটা চাদর।
এবার আমাকে আর তেহানিকে পাশাপাশি বসতে বলা হলো চাদরগুলোর ওপর। বসলাম আমরা। আমাদের ডানে বয়ে এনে রাখা হতে লাগল উপহার। দেখতে দেখতে পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে উঠল গৃহস্থালি জিনিসপত্রের স্তূপ। আনুষ্ঠানিক ভাবে উপহারগুলো গ্রহণ করলাম আমি আর তেহানি।
এরপর হিনা আর টেয়ানুই একটা করে পাওনিহো চাইল। পাওনিহো এক ধরনের ছড়ি। লোহাকাঠের তৈরি। মসৃণ, খাটো, মাথায় তীক্ষ্ণধার হাঙ্গরের দাঁত লাগানো। প্রতিটা ইন্ডিয়ান রমণীর এ ধরনের পাওনিহো আছে। শোক করার সময় ওগুলো দিয়ে মাথায় আঘাত করে রক্ত ঝরায় ওরা।
বিয়ে শোকের অনুষ্ঠান না হলেও হিা আর টেতুয়ানুই পাওনিহোর আঘাতে কেটে ফেলল কপাল। এমন আচমকা কাজটা করে বসল ওরা, বাধা দেয়ার কোন সুযোগই আমি পেলাম না। পুরোহিত তাওমি এবার দুহাতে ওদের দুজনকে ধরে ধীর পায়ে ঘুরতে লাগল আমাদের চারপাশে। দুই পরিবারের দুই কর্ত্রীর মাথা থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়ে ভিজে উঠতে লাগল টেয়ানুই এর বিছানো কাপড়। কিছুক্ষণ পর শেষ হলো অনুষ্ঠানের এ পর্যায়। আমাকে আর তেহানিকে উঠতে বলা হলো। দুই পরিবারের রক্তে রাঙা কাপড়টা উঠিয়ে ভাঁজ করে রেখে দেয়া হলো সযত্নে।
এরপর আবার মিছিল করে কনের বাড়িতে যাওয়া। একই অনুষ্ঠান-এমন কি চাদর রক্তে রাঙানো এবং ভাজ করে উঠিয়ে রাখা পর্যন্ত আবার অনুষ্ঠিত হলো। তারপর শুরু হলো ভোজ। মেয়েরা এক দিকে ছেলেরা অন্যদিকে। বিকেল পর্যন্ত চলল খাওয়া দাওয়া।
বিয়ের সামাজিক অনুষ্ঠানাদি শেষ। এখন বাকি শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান। ভেহিয়াটুয়ার পারিবারিক মারাএ অর্থাৎ মন্দিরে হবে এ অনুষ্ঠান। বৃদ্ধ তাওমির, নেতৃত্বে ধীর গম্ভীর পদক্ষেপে মিছিল করে মন্দিরে পৌঁছুলাম আমরা।
বিশাল এক অশ্বথ গাছের নিচে দেয়াল ঘেরা এক জায়গায় মন্দিরটা। মেঝে বাধানো পাথর দিয়ে। এক পাশে একটা পিরামিড; ত্রিশ গজ মত লম্বা, চওড়া বিশ গজ, চার ধাপে উঠে গেছে প্রায় চল্লিশ ফুট উঁচুতে। ওটার চূড়ায় কাঠ খোদাই করে বানানো অদ্ভুত এক পাখির প্রতিমা।
হিটিহিটি আর হিনার সঙ্গে আমাকে নিয়ে অনিয়া হলো ঘেরা জায়গার এক কোনায়। তেহানি, ভেহিয়াটুয়া আর ওদের অন্য আত্মীয় স্বজন রইল আমাদের সামনে, ঘেরা জায়গার অন্যপাশে। বৃদ্ধ পুরোহিত এবার আমার কাছে এসে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল:
এই নারীকে তুমি স্ত্রী হিসেবে চেয়েছ; ওর জন্যে তোমার যে ভালবাসা কোন দিন তা শীতল হবে না তো?
না, আমি জবাব দিলাম।
ধীরপায়ে হেঁটে এরপর তেহানির সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তাওমি। একই প্রশ্ন করল ওকে। জবাবও পেল এক। এবার সে ইশারা করল অন্যদের উদ্দেশ্যে। মারাএর দুপ্রান্ত থেকে তারা এগিয়ে এল দুই পরিবারের রক্ত মাখা চাদর দুটো নিয়ে। বিছিয়ে দিল। এরপর এগিয়ে এল নিচু পদমর্যাদার কয়েকজন পুরোহিত। প্রত্যেকের হাতে একটা করে মড়ার খুলি। বিয়ের নীরব সাক্ষী। ভেহিয়াটুয়ার পরিবারের পূর্বপুরুষদের খুলি ওগুলো। পাহাড় চুড়ার পবিত্র গুহায় সংরক্ষিত থাকে খুলিগুলো। বিয়ে বা খুলি প্রয়োজন হয় এমন কোন অনুষ্ঠানের আগে পাহাড় থেকে আনিয়ে নেয়া হয়। অনুষ্ঠান শেষে আবার রেখে আসা হয়। যেখানকার জিনিস সেখানে।
রক্তমাখা কাপড়গুলোর ওপর আমাকে আর তেহানিকে বসতে বলা হলো। হাত ধরাধরি করে। আমাদের দুই পরিবারের অন্য সদসারা বসল দুপাশে। এরপর প্রধান পুরোহিত একে একে অতীতের নামকরা সব গোত্রপতি এবং বীরদের পূর্ণ নাম, পদবী আউড়ে আহ্বান করতে লাগল বিয়েতে সাক্ষী থেকে আশীর্বাদ করার জন্যে। অনেকক্ষণ পর ক্লান্তিকর ব্যাপারটা শেষ করে আমার দিকে ফিরল তাওমি।