চলো এবার, আমার কুটুম্বের বাড়িতে যাই, বলল সে।
বিশালদেহী এক লোক হাঁটু গেড়ে পেছন ফিরে বসল ভেহিয়াটুয়ার সামনে। অনায়াস ভঙ্গিতে তার কাঁধে চড়ে বসল গোত্রপতি। বিশালদেহী লোকটা এবার উঠে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করল। ভেহিয়াটুয়া, টেইনা এবং আরও দুতিন জন মহা-গোত্ৰপতি এভাবেই চলাফেরা করে। কারণ তাদের অধিকার এত ব্যাপক যে যেখানে তাদের পা পড়ে সে জায়গা, তাদের নিজের সম্পত্তি হয়ে যায়। তাই সাধারণ প্রজাদের জমিজমা রক্ষা করার জন্যে এই ব্যবস্থা।
তেহানিকে পাশে নিয়ে তার চাচার পেছন পেছন এগোলাম আমি।
ভেহিয়াটুয়ার কুটুম্ব আর কেউ নয়, আমার তাইও হিটিহিটি। ব্যস্ত সমস্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে সে অভ্যর্থনা জানাল কুটুম্বকে। রাজসিক খাওয়া দাওয়ার আয়োজন শুরু হলো সঙ্গে সঙ্গে। আগে থাকতেই জানাশোনা আছে তেহানি আর হিনার। কলকণ্ঠে গল্প শুরু করল দুজন। ওদের আলাপ না শুনতে পেলেও হিনা বার বার আমাদের দিকে তাকাচ্ছে দেখে ধারণা করলাম, সকালে নদীতে আমাদের সাক্ষাতের কথা বলছে তেহানি।
দুপুরের পর সবাই কোন গাছ বা চালার ছায়ার আশ্রয় নিল ঘুমাবে বলে। আমার অবস্থা ঘুমানোর মত নয়। তেহানির কথা ভাবতে ভাবতে সকতের দিকে চললাম। সৈকতের কাছেই একটা হিবিসকাস গাছে গয়ায় দেখলাম
আমার তাইওকে। জেগেই আছে। পাশে গিয়ে বসলাম আমি।
ঘুমাওনি, বিয়্যাম? একটু যেন অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করা হিটিহিটি।
ঘুম আসছে না।
কেন?
তেহানির সাথে আমার সাক্ষাতের কথা বললাম হিটিহিটিকে। তাতে কি হয়েছে? প্রশ্ন করল হিটিহিটি।
আমার মনের শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে, আমি বললাম। আমি ওকে ভালবেসে ফেলেছি, হিটিহিটি।
ভাল, এখন যদি ও রাজি হয় বিয়ে করে ফেল।
আমার মনে হয় ও রাজি হবে, কিন্তু ওর বাপ মা…
বাপ মা নেই ওর। দুজনই মরে গেছে।
তাহলে ভেহিয়াটুয়া?
ও তোমাকে পছন্দ করে। আমার মনে হয় না ও অমত করবে।
ভাল। ধরো আমাদের বিয়ে হলো, তারপর আমার দেশ থেকে একটা জাহাজ এসে জানাল, আমাকে দেশে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন রাজা জর্জ!
হতাশ ভঙ্গিতে প্রশস্ত কাঁধ দুটোয় একটু ঝাঁকুনি দিল হিটিহিটি। তোমরা ইংরেজরা সব এক রকম। যা হয়তো কখনোই ঘটবে না তা নিয়ে ভেবে জীবন দুর্বিসহ করে তোল। আজই কি যথেষ্ট নয় যে কাল বা পরশু নিয়ে মাথা ঘামাও? একটা জাহাজ হয়তো কোন দিন আসবে, এই ভেবে তুমি তোমার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবে না। সে জাহাজ আসতে আসতে হয়তো দশ বা বিশ বছর পেরিয়ে যাবে! যত্তসব শোনো, বিয়্যাম, গতকাল গত হয়ে গেছে, আজ আছে হাতে, আগামী কাল হয়তো কোনদিনই আসবে না তোমার জীবনে।
বৃদ্ধ বন্ধুর দার্শনিক কথা শুনে হাসলাম, যদিও, তবে একটু ভাবতেই বুঝলাম, ও ঠিকই বলেছে।
তুমি আমার তাইও, অবশেষে আমি বললাম, এদেশে তো আমার আপন কেউ নেই, আমার হয়ে ভেহিয়াটুয়ার সাথে কথা বলবে তুমি? বলবে ওর ভাস্তিকে আমি ভালবাসি, বিয়ে করতে চাই।
বলব মানে! একশো বার বলব। উৎফুল্ল কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল হিটিহিটি। অনেক দিন হলো স্ত্রী ছাড়া আছ তুমি! এবার ভাগো, আমাকে ঘুমাতে দাও।
.
কারও ঘুম ভাঙার আগেই হোনি উঠে হাঁটতে হাঁটতে সৈকতে এল। আমাকে দেখেই চঞ্চলা হরিণী হয়ে উঠল যেন। ছুটে এল কাছে।
আমার তাইওর সাথে আলাপ করলাম, তেহানি, আমি বললাম। আমার বিদ্রোহ পক্ষ থেকে ও তোমার চাচার কাছে প্রস্তাব রাখবে, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। ভুল হচ্ছে না তো আমার?
আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তেহানি বলল, ঘুমাতে যাওয়ার আগে চাচাকে আমি বলেছি, আমি তোমাকে স্বামী হিসেবে চাই। চাচা জিজ্ঞেস করছিল, তুমি আমাকে চাও কি না। আমি বলেছি, তুমি চাও না চাও তোমাকে আমার পেতেই হবে। চাচা তখন বলল, তুই কি চাস বিয়্যামকে অপহরণ করে ওর তাই ওর সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি আমি? আমি বলেছি, হ্যাঁ, প্রয়োজন হলে করতে হবে যুদ্ধ! চাচা তখন সস্নেহে আমাকে বলেছে, তোর মা মারা যাওয়ার পর থেকে কোন চাওয়া তোর আমি অপূর্ণ রেখেছি রে, ছোট্ট পায়রা? তোর এই বিয়্যাম বিদেশী, তবু সে তো পুরুষ। কোন পুরুষই তোর ইচ্ছার কাছে মাথা না নুইয়ে পারবে না! বলো, চাচা কি ঠিক বলেছে?
হ্যাঁ আমার মনে হয় ঠিকই বলেছে, ওর হা দুটো আমার হাতে তুলে নিয়ে বললাম।
হাত ধরাধরি করে আমরা যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন সন্ধ্যা হয় হয়। ভেহিয়াটুয়া বলল, এই যে বা এসে গেছে।
দুজনকেই একটু বা খুশি খুশি লাগছে, মৃদু হেসে মন্তব্য করল আমার তাইও তারপর আমাকে বলল, তেহিয়াটুয়া রাজ, তবে একটা শর্তে, বিয়ের পর তোমাকে ওর সঙ্গে টাউতিরায় থাকতে হবে। ভাস্তিকে কিছুতেই ও চোখের আড়াল করতে পারবে না। আমার মনে হয় না তাতে খুব একটা অসুবিধা হবে তোমার, মাঝে মাঝে এসে বেড়িয়ে যাবে আমাদের…
আর শোনার জন্যে দাঁড়ালাম না আমি ছুটে ঘরের ভেতর গিয়ে আমার বাক্স খুলে বের করে অনলাম সেই হারটা–ইন্ডিয়ানদের ভেতর যদি মনের মানুষ পেয়ে যাই দেব বলে যেটা এনেছিলাম। ভেহিয়াটুয়ার হাতে ওটা তুলে দিয়ে বললাম, তেহানির জন্যে আমার উপহার।
হুঁ, খুশি হবে ও, বলল ভেহিয়াটুয়া। এ অঞ্চলে আর কোন মেয়ের এমন জিনিস নেই। সত্যিই রাজসিক উপহার। এবার বলো তো, বিয়্যাম, তোমাকে আমরা কি দেই?