তুমিও! মৃদু হেসে জবাব দিল তেহানি। মি কে আমি জানি তুমি বিয়্যাম, হিটিহিটির তাইও, না?
হ্যাঁ। তুমি কে বলিতুমি তেহানি, পইনোর আত্মীয়। টেতিয়াবোয়ায় তোমার নাচ দেখেছিলাম।
এবার শব্দ করে হেসে উঠল মেয়েটা। সত্যিই আমাকে দেখেছিলে? কেমন লেগেছিল আমার নাচ।
এত সুন্দর!-জীবনে ভুলব না সে রাতের কথা!
আরেরো মোনা! হাসতে হাসতেই সে বলল। অর্থাৎ, গল্পবাজ।
এমন সুন্দর তুমি নেচেছিলে যে, আমি বলে চললাম, যেন ওর কথা আমার কানেই যায়নি, আমি হিটিহিটিকে জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হয়েছিলাম, ওই সুন্দরী মেয়েটা কে? ও আসলে মেয়ে না কি নাচের দেবী সশরীরে মর্ত্যে নেমে এসেছেন?
আরেরো মোনা! আবার বলল ও। বলল বটে কিন্তু গালের রক্তিমাভাটা লুকাতে পারল না। এসো-দেখি ডুব সাঁতারে কে বেশি দূর যেতে পারে, তুমি না আমি!
বলে আস্তে করে শিকড় থেকে ও পানিতে নেমে এল। আমার সোজাসুজি এসে বলল, ওই দিকে যাব। হ্যাঁ, এবার এক-দুইতিন।
ডুব দিলাম আমি। পানির এক ফ্যাদম মত নিচে দিয়ে সঁতরে চললাম তেহানির দেখানো দিকে। স্রোতের পক্ষে থাকায় বেশ দ্রুত এগোতে পারলাম। শেষে বাতাসের অভাবে ফুসফুস যখন ফেটে যেতে চাইছে, ভেসে উঠে ভুস করে দম নিলাম। পেছন ফিরে খোঁজ করছি তেহারি-কল্পনাও করতে পারিনি সাঁতারে আমার চেয়ে দক্ষ হতে পারে কোন মেয়ে। এই সময় সামনে থেকে ভেসে এল মধুর ঘন্টাধ্বরি মত রিনরিনে একটা হাসি। চমকে মুখ ঘোরাতেই দেখলাম আমার কমপক্ষে দশগজ সামনে জলের ভেতর নেমে আসা লম্বা একটা শিকড়ের ওপর বসে আছে সে।
তুমি এসে গেছ? হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।
দেখতেই পাচ্ছ। ভেবো না আমি পানির ওপর দিয়ে এসেছি।
না, অতটা নীচ আমি নই যে তেহানিকে প্রবঞ্চক ভাবব। বললাম, ঠিক আছে, একটু জিরিয়ে নেই, তারপর আবার দেখব।
ওর পাশে শিকড়ের ফাঁকা অংশটার দিকে ইশারা করল তেহানি। এসো, এখানে বসে জিরও।
মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে চোখের ওপর থেকে ভেজা চুল সরাতে সরাতে আমি উঠে বসলাম ওর পাশে। চুপ করে আছি। তেহানিও চুপ। তারপর অনেকক্ষণ পর-কতক্ষণ কাতে পারব না-আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম ওর দিকে। কি আশ্চর্য! ঠিক একই মুহূর্তে ও-ও তাকিয়েছে আমার দিকে। ওর বাদামী চোখ দুটোয় হাসির ঝিলিক। হঠাৎ করেই মুখ ঘুরিয়ে নিল তেহানি। বুঝতে পারছি আমার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠছে। আমার পাশেই শিকড় আঁকড়ে আছে ওর হাত। আস্তে হাতটা তুলে নিলাম আমি।মুখ নিচু করে পানির দিকে তাকাল তেহানি।
তেহানি! আমি ডাকলাম। দুহাতে ধরলাম ওর হাতটা।
জবাব দিল না তেহানি। ধীরে ধীরে মুখ উঁচু করে ঘোরাল আমার দিকে। তারপর আমি বা ও কিছু টের পাওয়ার আগেই আমার বান্দ্র বাঁধনে ধরা পড়ল
ও।
বিয়্যাম, আমার কপাল থেকে ভেজা চুল সরিয়ে দিতে দিতে তেহানি বলল, ভোমার স্ত্রী নেই
না।
আমারও স্বামী নেই।
এই সময় ডাঙার ওদিক থেকে ভেসে এল নারীকন্ঠের চিৎকার: তেহানি! তেহানি ও!
তেহানিও চিৎকার করে জবাব দিল: আসি!
ও আমার দাসী। আমার সাথে এসেছে তাহিতিতে। নদীর মুখে ওকে দাঁড়াতে বলে আমি এসেছিলাম গোসল করতে।
টেতিয়ারোযা থেকে এসেছ তুমি?
না। আমি টাউতিরায় থাকি, চাচার সাথে। দুদিন দুরাত সাগর পাড়ি দিয়ে কিছুক্ষণ আগে পৌঁছেছি এখানে।
তোমার চাচা কে?
অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল মেয়েটা। তুমি জানো না?
না।
আমাদের ভাষায় কথা বলতে পারো, তারপরও! আশ্চর্য মানুষ তোমরা ইংরেজরা! আমার চাচা ভেহিয়াটুয়া, টাইয়ারাপুর মহা-গোত্রপতি।
হ্যাঁ নাম শুনেছি ওঁর।
তুমি কি তোমার দেশের কোন গোত্রপতি?
তা বলতে পারো, যদি ও খুব ছোট দরের।
যা ভেবেছি। তোমাকে প্রথমবার দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। সাধারণ কাউকে তাইও করবে না হিটিহিটি!
আবার আমরা চুপ। দুজনেই বুঝতে পারছি দুজনের মনের কথা।
তেহানি, কিছুক্ষণ পর আমি ডাকলাম।
হ্যাঁ।
মুখ তুলল ও। আমি ঠোঁট ছোঁয়ালাম ওর ঠোঁটে।
.
সাগর সঙ্গমে পৌঁছে দেখলাম, বৃদ্ধ ভেহিয়াটুয়া নাশতা করতে বসেছে। রুটিফল, ঝলসানো মাছ আর কল। ভাইঝির সাথে আমাকে দেখে একটুও অবাক হলো না সে।
তেহানি, সস্নেহে বলল বৃদ্ধ গোত্রপতি, কে রে তোরসঙ্গের লোকটা?
হিটিহিটির তাইও-ওর নাম বিয়্যাম।
আহ, বিয়্যাম! ওর কথা তো শুনেছি আমি। বলে আমার দিকে তাকাল ভেহিয়াটুয়া। বসো, খাও আমার সাথে। তেহানি, বড় ক্যানোয় তোর নাশতা তৈরি। যা খেয়ে নে।
ছোট একটা ক্যানো ভিড়ে ছিল সৈকতে। তাতে উঠে তীর থেকে কিছু দূরে ভেসে থাকা একটা বড় জোড়া ক্যানোয় চলে গেল তেহানি। আমি বসলাম ভেহিয়াটুয়ার পাশে। হিটিহিটি, বাউন্টি এবং আমার সঙ্গী, যারা তাহিতিতে থেকে গেছে তাদের সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করল সে। যথাসাধ্য আমি সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করলাম বৃদ্ধকে।
তাহলে বন্ধুদের সাথে তাহিতিতেই থেকে যাচ্ছ তুমি? অবশেষে জিজ্ঞেস করল ভেহিয়াটুয়া।
আঁ…অন্তত কিছু দিনের জন্যে। রাজা জর্জ যদি জাহাজ পাঠিয়ে আমাদের দেশে ফেরার আদেশ দেন তাহলে না ফিরে পারব না।
তা ঠিক, বলল বৃদ্ধ গোত্রপতি, রাজার আদেশ তো মানতেই হবে।
একটু পরেই তেহনি ফিরে এল তীরে। শুধু নাশতা নয়, সামান্য প্রসাধনও করে এসেছে। তাতেই এতখানি বদলে গেছে ওর চেহারা যে চোখ ফেরানো যায় না। আমি অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম। এই কি কিছুক্ষণ আগের সেই গেছো মেয়ে, যে আমাকে হারিয়ে দিয়েছে ডুব সাঁতারে? চমৎকার চুলগুলো রোদে শুকিয়ে আঁচড়ে নিয়েছে, সামান্য সুগন্ধিও বোধহয় লাগিয়েছে। গ্রীসীয় ঢংয়ে ছাঁটা তুষার শুভ্র একটা কুঁচিওয়ালা বুল পোশাক পরেছে। ছোট একদল মহিলার সামনে থেকে ও যখন মাথা উঁচু করে এগিয়ে এল, আমার মনে হলো সত্যিই রাজকন্যা আসছে। আমার দিকে তাকিয়ে সামান্য মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়াল বৃদ্ধ গোত্রপতি।