আবার নৈঃশব্দ্য গ্রাস করল আমাদের। সৈকতে সাগরের ঢেউ ভেঙে পড়ার মৃদু শব্দ আর নারকেল পাতার মৃদু সর সর আওয়াজ কেবল শোনা যাচ্ছে।
আজ হোক কাল হোক,অনেকক্ষণ পর আবার শুরু করল ক্রিশ্চিয়ান, কোন ব্রিটিশ জাহাজ এখানে নোঙ্গর ফেলবে। তোমরা যারা বিদ্রোহে জড়িত ছিলে না, সেই জাহাজের ক্যাপ্টেনের কাছে গিয়ে বোলো সত্যি কথাটা। আমার মনে হয় না তোমাদের কোন ক্ষতি হবে। কেন হবে? তোমরা তো নিরপরাধ।
সেই অনুরোধটা আরেকবার তোমাকে করতে চাই, বিয়্যাম-যদি কখনও দেশে ফিরতে পারো কষ্ট করে একটু দেখা কোরো আমার বুড়ো বাবার সাথে। তাকে বুঝিয়ে বোলা, কি পরিস্থিতিতে আমি ওই জঘন্য কাজটা করতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমার বাবার নাম চার্লস ক্রিশ্চিয়ান। কাম্বারল্যান্ডের মেয়ারল্যান্ডক্লের-এ খোঁজ করলেই পাবে তাঁকে।
এক মুহূর্ত থেমে অনুনয়ের সুরে ও বলল, বিয়্যাম, করবে না এটুকু আমার জন্যে।
করব, মাথা ঝাঁকিয়ে আমি বললাম।
হিটিহিটির বাড়ির দিকে মুখ ফিরিয়ে ক্রিশ্চিয়ান ডাকল, মাইমিতি!
ডাকটার জন্যে যেন উন্মুখ হয়ে ছিল মেয়েটা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একগুচ্ছ নারকেল গাছের আড়াল থেকে সে বেরিয়ে এল। দুজন হাত ধরাধরি করে গিয়ে উঠে পড়ল সৈকতে ঠেকে থাকা একটা ক্যানোয়। আমিও গেলাম ওদের পেছন পেছন। ক্রিশ্চিয়ান আমার হাত ধরে বলল, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।
দাঁড় টানতে শুরু করল দাড়িরা। যতক্ষণ না ক্যানোটা গিয়ে ভিড়ল বাউন্টির গায়ে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম অন্ধকার সৈকতে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে এলাম বাড়িতে।
পরদিন ভোরে স্নান করার জন্যে সাগর তীরে গিয়ে দেখি রওনা হয়ে গেছে। বাউন্টি। সবগুলো পাল মেলে দিয়ে ছুটে চলেছে উত্তর দিকে।
এগারো
আজকাল বেশির ভাগ সময়ই মনটা ভার হয়ে থাকে নানা চিন্তায়। মায়ের কথাই বেশি মনে পড়ে। আমার তাইও হিটিহিটির বাড়িতে খুব যে কষ্টে আছি তা নয়, বরং উল্টোটাই। তবু মনে শান্তি নেই। বার বার ঘুরে ফিরে মনে হানা দেয় কথাটা-কি থেকে কি হয়ে গেল! মাঝে মাঝে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কেই সন্দিহান হয়ে উঠি। মনে হয়, এমন কোন পাপ তো জীবনে করিনি যার জন্যে এত কঠিন শাস্তি আমাদের প্রাপ্য হবে।
এই সব মন ভার করা ভাবনা ভুলবার জন্যে একদিন বাক্স থেকে বের করলাম আমার পাণ্ডুলিপিটা। প্রথমে মন বসাতে কষ্ট হলেও কয়েক দিনের মধ্যেই আবার ডুবে গেলাম কাজে।
.
বাউন্টি চলে যাওয়ার দিন দশেক পর এক শেষ রাতে হঠাৎ কোন কারণ ছাড়াই জেগে গেলাম আমি। আর ঘুম এল না। বেশ কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করার পর পয়েন্ট ভেনাস থেকে ঘুরে আসি, ভেবে বিছানা থেকে নেমে এলাম। সকাল হতে ঘন্টাখানেক বাকি আকাশে তখনও তারার মেলা। মৃদু উষ্ণ উত্তরে হাওয়া ভেসে আসছে বিষুবীয় অঞ্চল থেকে। দীর্ঘ ধনুকের মত বাঁকানো সৈকতের ওপর দিয়ে এগিয়ে চললাম আমি।
তাহিতির যে কটা জায়গা আমার প্রিয় তার ভেতর প্রিয়তম এই পয়েন্ট ভেনাস। এমনিতেই রোজ ভোরে আমি চলে আসি এখানে। সূর্যোদয় দেখি। আজ একটু আগে এসেছি এই যা। সরু নদীটা, যার নাম ভাইপুপু, যেখানে সাগরে মিশেছে সেখানে ছোট্ট এক টুকরো সৈকত। জায়গাটা এখন জনশূন্য দেখে ভাল লাগল আমার। উঁচু একটা বালিয়াড়ির ওপর উঠে বসলাম পুবমুখী হয়ে।
একটু পরেই ভোরের প্রথম আলোর রেখা দেখা দিল দিগন্তে। তারপর আস্তে আস্তে রাঙা হয়ে উঠতে লাগল পুবের আকাশ, সেই সাথে সাগর। দুচোখ মেলে তাকিয়ে রইলাম আমি। সূর্য যখন পুরোপুরি উঠে এল দিগন্ত রেখার ওপরে তখন নেমে এলাম বালিয়াড়ি থেকে। ভাইপপুর পাড় ধরে এগিয়ে চললাম পয়েন্টের পশ্চিম দিকে যেখানে সাগরে মিশেছে নদীটা। মোহনার কাছেই নদীর একটা জায়গা অদ্ভুত শান্ত। স্রোত আছে কি নেই বোঝাই যায় না। অন্তত বিশ গজ চওড়া জায়গাটা। গভীরতা প্রায় দেড় মানুষ সমান। সাঁতার কাটার আদর্শ স্থান। লোকালয় থেকে দূরে এমন একটা নির্জন জায়গা পেয়ে আমি রীতিমত ভৗগ্যবান মনে করি নিজেকে। রোজ সকালে সূর্যোদয় দেখার পর এখানে কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে, স্নান করে বাড়ি ফিরি।
গায়ের ইন্ডিয়ান আলখাল্লাটা খুলে রেখে আস্তে আস্তে নেমে পড়লাম নদীতে। দুহাতে নিঃশব্দে জল কেটে এগোলাম ভাটির দিকে। হঠাৎ অদ্ভুত অপরূপ এক দৃশ্য দেখে জমে গেলাম যেন আমি। প্রাচীন একটা গাছের নদীর দিকে বেরিয়ে আসা একটা মোটা শিকড়ের ওপর বসে আছে এক তরুণী। প্রথম দর্শনে মনে হলো জলদেবী বুঝি। নিশ্চয়ই কোন শব্দ করে ফেলেছিলাম, কারণ মুহূর্ত পরেই দেখি চমকে সে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়েছে আমার দিকে। চমকে উঠলাম আমিও। এ সেই তেনি-চার্চিলদের ধরতে গিয়ে যার নাচ দেখেছিলাম টেতিয়ারোয়ায়। সংকোচ বা লজ্জার কোন চিহ্ন নেই চেহারায়। থাকার কথাও নয়। এখানকার সমাজে ওর মত মেয়েরা যে সম্মান বা মর্যাদা ভোগ করে তার তুলনা হয় না। বিরক্ত বা অপমান করেছে বলে কারও বিরুদ্ধে ও যদি অভিযোগ করে মৃত্যু ছাড়া আর কোন শাস্তি তাকে দেয়া হবে না। নিরাপত্তার এই নিশ্চয়তা আছে বলেই তেহানির মত মেয়েরা যখন যেখানে খুশি যাওয়া আসা করে নিঃসংকোচে।
চমক ভাঙতেই ইন্ডিয়ান রীতিতে আমি বললাম, বেঁচে থাকো অনেক দিন।