পরিখার কাজ শেষ হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই প্রমাণ পাওয়া গেল ক্রিশ্চিয়ানের দূরদৃষ্টির।
দ্বীপে নেমেই আমাদের আনা জন্তু জানোয়ার সব ছেড়ে দিয়েছিলাম পাহাড়ে, বনে। ইতোমধ্যে সেগুলোর কোন কোনটা বাচ্চা দিয়েছে। এখন আর শুধু বনের খাবারে কুলায় না তাদের। বন ছেড়ে এসে হামলা চালায় দ্বীপবাসীদের টারো খেতে। ওদের ধরতে বা মারতে ব্যর্থ হয়ে দ্বীপবাসীরা ক্রিশ্চিয়ানের কাছে প্রতিকার চাইল। প্রথমবার ক্রিশ্চিয়ান বুঝিয়ে দিল, একটু সহ্য করো, কদিন পরেই আর তোমাদের খাবারের অভাব থাকবে না।
কয়েক দিন পর আবার এল জংলীরা। এবার ওরা মারমুখী। বলল, মারো ওগুলোকে, না হলে তোমাদেরই এদেশ ছাড়া করে ছাড়ব।
এবার আমরা বুঝতে পারলাম কেন এত পরিশ্রম করে পরিখা খুঁড়িয়েছিল ক্রিশ্চিয়ান। কয়েক সপ্তাহ আমরা বন্দী হয়ে রইলাম দুর্গের ভেতর। বেরোনোর চেষ্টা করলেই বাধা দেয় হিংস্র টুপুয়াইবাসীরা। একটু একটু করে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে শুরু করেছিল সবাই। অবশেষে একদিন আমাদের ডেকে হাত তুলতে বলল ক্রিশ্চিয়ান। টুপুয়াই ছেড়ে যাওয়ার পক্ষে মত দিল সব কজন। ষোলো জন তাহিতিতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা জানাল, বাকিরা জনশূন্য কোন দ্বীপের সন্ধানে পাড়ি জমাতে চাইল বাউন্টিতে চেপে। যারা বাউন্টিতে থাকবে বলে ঠিক করল তারা হলো: ফ্লেচার ক্রিশ্চিয়ান, জন মিলস, এডওয়ার্ড ইয়ং, উইলিয়াম ব্রাউন, আইজাক মার্টিন, উইলিয়াম ম্যাককয়, জন উইলিয়ামস, ম্যাপ্ত কুইনটাল, আর আলেকজান্ডার স্মিথ।
আমরা টুপুয়াই ছেড়ে চলে যাব জানাতেই ইন্ডিয়ানরা অবরোধ তুলে নিতে রাজি হলো। আবার অমানুষিক পরিশ্রম করে বাউন্টিকে জলে ভাসানো হলো। খাবার, পানি, এবং অন্যান্য জিনিসপত্র বোঝাই দেয়া হলো। ছেড়ে দেয়া জন্তু জানোয়ারের যতগুলোকে সম্ভব ধরে খাঁচায় পোরা হলো, বাকিগুলোকে মেরে মাংস নুন দিয়ে নেয়া হলো। তারপর আবার পাল তুলল বাউন্টি এবং পাঁচদিন পর নোঙ্গর ফেলল মাতাভাই উপসাগরে শেষ বারের মত।
.
হিটিহিটির বাড়িতে ফিরে এলাম আমি।
সব জিনিসপত্র বিশেষ করে অভিধানের অমূল্য পাণ্ডুলিপিটা (এত কিছুর ভেতরেও আমি সযত্নে সংরক্ষণ করেছি ওটা) সহ যখন পৌঁছলাম সবাই ঘিরে ধরল আমাকে। বিশ্রামেরও সময় দেবে না, এতদিন কোথায় ছিলাম, কি করেছি তা শোনাতে হবে। বারান্দায় বসে শুরু করলাম আমার কাহিনী বিদ্রোহের অংশটুকু ছাড়া (ক্রিশ্চিয়ানকে আমরা কথা দিয়েছি, ইন্ডিয়ানদের কাছে বিদ্রোহের কথা কোন দিন প্রকাশ করব না। আর সব বলে গেলাম।
চোখ বড় বড় করে শুনল ওরা। তারপর হিনা প্রশ্ন করল, এবার তোমরা কি করবে? কিছুদিন থাকবে আমাদের এখানে?
কাল অথবা পরশু ক্রিশ্চিয়ান আর অন্য আটজন আইটুটাকির পথে রওনা হয়ে যাবে। আমরা বাকিরা-যারা তোমাদের দ্বীপটাকে ভালবেসে ফেলেছি, থেকে যাব এখানে। বাকি জীবন এখানেই কাটিয়ে দেব যদি তোমরা অনুমতি দাও।
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই হিনা বুকে জড়িয়ে ধরল আমাকে। নাকে নাক ঠেকিয়ে লম্বা করে কয়েকবার শ্বাস টানল ওদের রীতিতে। তারপর বলল, আহ, বিয়্যাম, কি খুশি যে হয়েছি তোমাকে পেয়ে আমরা সবাই। তুমি চলে যাওয়ায় আমাদের বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল একেবারে।
হ্যাঁ, বলল হিনার স্বামী। এখন থেকে তুমি আমাদের একজন। তোমাকে আমরা আর কোথাও যেতে দেব না!
সন্ধ্যার সামান্য আগে ক্রিশ্চিয়ান এল মাইমিতিকে নিয়ে। মাইমিতি সম্ভবত শেষ বারের মত এসেছে আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করতে। ক্রিশ্চিয়ানের সঙ্গে ও-ও অজানার পথে বেরিয়ে পড়বে, ঠিক করেছে। হিটিহিটির বাড়িতে কিছুক্ষণ বসে আমাকে নিয়ে সৈকতের দিকে এগোল ক্রিশ্চিয়ান। মাইমিতি রইল বাড়িতে।
গোধূলি বেলার ম্লান আলোয় বালুবেলার ওপর দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে চললাম আমি আর ক্রিশ্চিয়ান। দুজনই নিশ্চুপ।
এই আমাদের শেষ দেখা, অনেকক্ষণ পর আচমকা বলে উঠল ক্রিশ্চিয়ান। কাল ভোরেই আমরা রওনা হয়ে যাচ্ছি।
বিদ্রোহের কাহিনী শুনিয়েছি তোমাকে, বলে চলল ও। মনে রেখো, আমি-যা, একমাত্র আমিই দায়ী ও ব্যাপারে। আর কেউ না। ব্লাই আর তার সঙ্গে যারা গেছে বোধহয় অনেক আগেই তারা মারা পড়েছে, হয় ডুবে নয়তো জংলীদের হাতে। ব্লাইয়ের জন্যে আমার কোন দুঃখ নেই। ওর মত লোক পৃথিবীতে থাকা না থাকা সমান। কিন্তু অন্য যারা বিনা কারণে ওর সঙ্গে প্রাণ দিতে বাধ্য হলো তাদের স্মৃতি আমার বুকের ওপর পাথরের মত চেপে আছে। কোন দোষ করেনি বেচারিরা। তবু.. মিস্ত্রী কি পরিস্থিতিতে আমি অমন ভয়ানক কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলাম তুমি জানো। আর সবাই জানে। তবু, আমি জানি, আমাকে কেউ ক্ষমা করতে পারবে না। আমার জন্যে দুঃখ বোধ করবে সবাই, সেই সাথে আমার অপরাধটাও দেখিয়ে দেবে চোখে আঙুল দিয়ে। তাই সবার চোখের আড়ালেই চলে যাব আমি। নিজে বাঁচার চেয়ে যারা আমার সঙ্গে তাদের জীবন জড়িয়ে নিয়েছে তাদের বাঁচানো আমার কাছে বড় এখন। বিশাল এই প্রশান্ত মহাসাগরের কোন না কোন অজানা দ্বীপে আমাদের ঠাঁই হবে। বাউন্টিকে ধ্বংস করে দিয়ে সেখানে আমরা থেকে যাব জীবনের জন্যে। আমাদের আর কখনও দেখবে না তোমরা। তোমাদের এই দুর্বিপাকে ফেলার জন্যে অন্তর থেকে আমি অনুতপ্ত। ক্ষমা আমি চাইব না। যদি জানতাম পাবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা আছে তাহলে চাইতাম।