এই ব্যাখ্যা শুনে পুরোপুরিই সন্তুষ্ট হলো ইন্ডিয়ানরা। শুরু হলো বিনিময় এবং ব্যবসা।
সেদিন সন্ধ্যায় ক্রিশ্চিয়ান, আর আমার তাইও হিটিহিটির সাথে খেতে বসেছি আমি। ক্রিশ্চিয়ানের মনের মানুষ মাইমিতিও আছে। ও খাচ্ছে না-ইন্ডিয়ান নারীরা পুরুষের সঙ্গে খায় না কখনও। গল্প করতে করতে খাওয়া চলল।
ডাঙায় আমার বাড়িতে থাকো, বিয়্যাম, এক সময় হিটিহিটি বলল।
জবাব দেয়ার সময় ক্রিশ্চিয়ানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির ছোঁয়া অনুভব করলাম আমি।
না, হিটিহিটি, জবাব দিলাম, এবার বোধহয় তা সম্ভব হবে না। মাত্র কয়েকদিন থাকব এখানে। তাছাড়া আমাদের লোক অনেক কমে গেছে। আমি তোমার বাড়িতে গেলে জাহাজের কাজে অসুবিধা হবে।
অবাক হয়ে ক্রিশ্চিয়ানের দিকে তাকাল হিটিহিটি।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকিয়ে ক্রিশ্চিয়ান বলল, জাহাজে ওকে দরকার হবে আমার।
ব্রিটিশ জাহাজের শৃঙ্খলা সম্পর্কে জানে হিটিহিটি, তাই এ নিয়ে আর কথা বাড়াল না।
বিকেলেই পেগি জাহাজে এসে উঠেছে। খাওয়ার পর ডেকে গিয়ে দেখি ও আর স্টুয়ার্ট পাশাপাশি বসে আছে প্রধান মাস্তুলের গোড়ায়। ইন্ডিয়ান ভাষায় কথা বলছে দুজন। পেগি চলে যাওয়ার পর স্টুয়ার্ট, মরিসন আর আমি পূর্বপরিকল্পনা মত মিলিত হলাম প্রধান হ্যাঁচের কাছে। * পেগিকে সব বুঝিয়ে বলেছি, স্টুয়ার্ট বলল। ও ভেবেছে ওর জন্যেই আমি পালাতে চাইছি জাহাজ ছেড়ে-একেবারে মিথ্যে নয় কথাটা। আর তোমাদের ব্যাপারটা ভেবেছে, ইন্ডিয়ান জীবন খুব পছন্দ হয়ে গেছে তাই তোমরা পালাতে চাইছ।
যা-ই ভাবুক, ও সাহায্য করবে কিনা তাই বলল, আমি বললাম।
হ্যাঁ। কিন্তু সমস্যা হয়েছে, ওদের পরিবারের একমাত্র বড় ক্যানোটা এখন টেতিয়ারোয়ায়। কাল যদি বাতাস অনুকূল থাকে একটা ছোট ক্যানো ও পাঠাবে ওটা নিয়ে আসার জন্যে।
আচ্ছা, ছোট ক্যানোয় করে পালাতে পারি না আমরা? জিজ্ঞেস করল মরিসন।
উঁহু, ছোট ক্যানোয় বেশি দূর যাওয়া যাবে না।
তার মানে অনুকূল বাতাসের জন্যে প্রার্থনা করা ছাড়া আপাতত আর কিছু করার নেই আমাদের? বলল মরিসন।
হ্যাঁ। রাতে খুশি মনে ঘুমাতে গেলাম। প্রায় নিশ্চিত, আমরা পালাতে পারব। তারপর এক বা দুবছর বড় জোর ইন্ডিয়ানদের ভেতর কাটাতে হবে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন জাহাজ এসে যাবে ইংল্যান্ড থেকে।
পরদিন সকালে দুজন শক্ত পোক্ত মানুষ পেগির ছোট ক্যানোটা নিয়ে চলে গেল উত্তরে টেতিয়ারোয়ার দিকে। রাতের ভেতরেই আশা করা যায় বড় ক্যানোটাকে নিয়ে ফিরে আসবে ওরা। সারা দুপুর উদ্বেগের সঙ্গে আবহাওয়ার ভাব চাল খেয়াল করলাম আমরা। তারপর যা ভেবেছিলাম ঠিক তা-ই ঘটল; বিকেল থেকে মেঘ জমতে শুরু করল আকাশে। সন্ধ্যা নাগাদ শুরু হয়ে গেল তুমুল ঝড়। এই ঝড়ে কোন ক্যানোর তীরে আসার কথা কল্পনাও করা যায় না।
নদিন পর থামল ঝড়। আকাশ আবার আগের মত ঝকঝকে নীল। দুপুরের সামান্য আগে পেগির বড় ক্যানোটা ফিরে এল টেতিয়ারোয়া থেকে। নদিন ধরে মনের ওপর চেপে বসে থাকা উদ্বেগ দূর হয়ে গেল মুহূর্তে। পেগি এল জাহাজে। ঠিক হলো সে-রাতেই পালাব আমরা।
কিন্তু শেষ মুহূর্তে আরও একবার ভাগ্য আমাদের সাথে প্রবঞ্চনা করল। বিকেল তিনটের সময় কারও সাথে কোন পরামর্শ না করে আচমকা নোঙর তোলার নির্দেশ দিল ক্রিশ্চিয়ান। তাহিতি পেছনে ফেলে এগিয়ে চলল কাউন্টি।
.
প্রথমবারের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও টুপুয়াইএ-ই বসতি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্রিশ্চিয়ান। এবার আমাদের সাথে রয়েছে নানা প্রজাতির অনেকগুলো করে জীব জন্তু-দ্বীপে ওগুলোকে ছেড়ে দেয়া হবে, যাতে ইচ্ছেমত বংশবৃদ্ধি করে আমাদের ভবিষ্যৎ খাবারের চাহিদা মেটাতে পারে। আরও আছে তিনজন ইন্ডিয়ান রমণী-ক্রিশ্চিয়ানের মাইমিতি, ইয়ং-এর টাউরুয়া, আর আলেকজান্ডার স্মিথের পারাহা ইটি। মাইমিতি আর টাউরুয়া এসেছে স্বেচ্ছায়, পারাহা ইটিকে অনেক বলে কয়ে আসতে রাজি করিয়েছে স্মিথ।
তাহিতি দৃষ্টিসীমার আড়ালে হারিয়ে যাওয়ার বেশ কয়েক ঘণ্টা পর আবিষ্কার করলাম, শুধু ওই তিনজন নয় আরও ইন্ডিয়ান আছে জাহাজে। নারী পুরুষ দুরকমই। নজন পুরুষ, বারোজন নারী আর আটটা ছেলে। কখন যে ওরা জাহাজে উঠে খোলের ভেতর লুকিয়েছে আমরা টেরও পাইনি।
অবশেষে টুপুয়াই-এ পৌঁছুলাম আমরা। এবার আর আগের মত মারমুখী হয়ে উঠল না স্থানীয় অধিবাসীরা। আমাদের সাথের তাহিতীয় লোকগুলোই তার কারণ। আমাদের ওপর প্রথম দর্শনে যে অবিশ্বাস জন্মেছিল, ওদের দেখে তা বোধহয় দূর হয়েছে টুপুয়াইবাসীদের। আমাদের সঙ্গী তাহিতীয়রা ওদের বোঝাল, আমরা ওদের দেশে বসতি করতে চাই, ওদের সাথে শত্রুতা আমাদের কাম্য নয়, আমরা থাকলে ওদের অনেক সুবিধা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ওরা মেনে নিল।
প্রচণ্ড পরিশ্রম করে জাহাজটাকে ডাঙায় টেনে তুললাম আমরা। সূর্য থেকে ডেকগুলোকে রক্ষা করার জন্যে ওপরে লতা পাতার চালা তুলে দিলাম। এরপর স্থানীয় এক গোত্রপতির কাছ থেকে সাগর তীরে এক টুকরো জমি কিনে একটা দুর্গ তৈরি করা হলো। দুর্গ মানে পাতায় ছাওয়া কুটির কয়েকটা, আর পুরো এলাকা ঘিরে চারপাশে শক্ত কাঠের বেড়া আর পরিখা। বিশ ফুট গভীর, চল্লিশ ফুট চওড়া পরিখাটা খোঁড়ার কাজে হাত লাগাতে হলো সবাইকে। বেশির ভাগ লোকই এই ভয়ানক পরিশ্রমসাধ্য কাজের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলল। জবাবে ক্রিশ্চিয়ান শুধু বলল, আমার নেতৃত্ব সম্পর্কে তোমরা প্রশ্ন তুলছ। ব্যসচুপ হয়ে গেল সবাই।