কোয়ার্টার ডেকে নিজের দলের লোকদের নিয়ে আলোচনায় বসল ও। আমরা যারা অবিদ্রোহী তাদের পাঠিয়ে দেয়া হলো সামনে, যেন ওদের আলাপ শুনতে না পাই। মিনিট পনেরো পরেই দেখলাম হাসতে হাসতে যে যার কাজে লেগে গেল বিদ্রোহীরা। উত্তর দিকে চলতে শুরু করল বাউন্টি।
কেউ আমাদের কিছু বলেনি তবু উত্তর দিকে এগোনো দেখে বলতে পারলাম বাউন্টির গন্তব্য একটাই হতে পারে-তাহিতি।
সেদিনই বিকেলে মরিসন, স্টুয়ার্ট আর আমি বার্থে বসে ফিসফিস করে যুক্তি করলাম, সত্যি যদি তাহিতিতেই আমাদের নিয়ে যায় ক্রিশ্চিয়ান, যে করে হোক পালাব আমরা। আজ হোক কাল হোক সভ্য দুনিয়ার কোন জাহাজ ওখানে আসবে। তখন আশা করা যায় দেশে ফেরা কঠিন হবে না আমাদের জন্যে।
.
দশ
পরদিন ক্রিশ্চিয়ান আবার আমাকে ডেকে পাঠাল ওর কেবিনে। গিয়ে দেখলাম চার্চিলও আছে। আমি ঢুকতেই রক্ষীকে বিদায় করে দরজা বন্ধ করে দিল সে।
তোমাকে একটা কথা বলার জন্যে ডেকেছি, বিয়্যাম, ক্রিশ্চিয়ান শুরু করল। আমরা এখন তাহিতির দিকে এগোচ্ছি। ওখানে সপ্তাহ খানেক থেকে খাবার, পানি ইত্যাদি সংগ্রহ করব।
আমার মুখ দেখেই মনের খবর আঁচ করতে পারল যেন ক্রিশ্চিয়ান। মাথা নেড়ে বলল, না, তোমাদের ছেড়ে দেব না তাহিতিতে। প্রথমে অবশ্য তা-ই ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার সাথীরা কেউ রাজি হলো না।
হ্যাঁ, মিস্টার বিয়্যাম, বলল সর্দিল। কাল অনেক রাত পর্যন্ত আমরা আলাপ করেছি তোমাদের নিয়ে। একটা ব্যাপারে সবাই এক মত, তোমাদের ভাল ছাড়া খারাপ আমরা কেউ চাই না। তবু ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
কারণটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ? জিজ্ঞেস করল ক্রিশ্চিয়ান। ছেড়ে যাওয়া তো পরের কথা, তাহিতিতে নামতেই দেয়া হবে না তোমাদের। ওরা বলছিল নিচে আটকে রাখতে। কিন্তু আমি তা চাই না। তাই ওদের বলেছি, বিদ্রোহ সম্পর্কে তাহিতীয়দের কাছে মুখ খুলবে না এরকম প্রতিশ্রুতি যদি দাও, তোমাদের ডেকে থাকতে দিতে আপত্তি করা উচিত হবে না। ওরা রাজি হয়েছে আমার কথায়।
বুঝতে পেরেছি, স্যার, আমি বললাম, যদিও আমি মনে করি আমাদের তাহিতিতে নামিয়ে দিয়ে গেলেই আপনারা…
অসম্ভব। ক্রিশ্চিয়ান বলল। যদিও ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমাদের ধরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আমি একদম মানতে পারছি না, তবু এছাড়া কোন উপায় নেই। তোমাদের ছেড়ে দিলেই ইন্ডিয়ানদের জানাবে বিদ্রোহের কথা। তখন ওরা আমাদের খাবার, পানি দেবে? দেবে না।
দেবে তো না-ই, হয়তো হামলা করে বসবে, বলল চার্চিল।
তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, আমি বললাম, সারা জীবন আমরা আপনাদের সাথেই থাকব?
আঁ-হ্যাঁ। সভ্য দুনিয়ার কাছে এখনও অজানা এমন কোন দ্বীপে নেমে আমরা ধ্বংস করে দেব বাউন্টিকে। বাকি জীবন ওই দ্বীপেই কাটাতে হবে আমাদের। তোমাদেরও।
হ্যাঁ, চার্চিল বলল, এছাড়া কোন পথ খোলা নেই আমাদের সামনে।
উঠে দাঁড়াল ক্রিশ্চিয়ান। অর্থাৎ, এবার তুমি বিদায় হতে পারো।
সুতরাং আমি বিদায় নিলাম।
ডেকের ওপর এসে বিষণ্ণ মুখে তাকিয়ে রইলাম ভোলা সাগরের দিকে।
.
মনের ভেতর ঘুর পাক খাচ্ছে ক্রিশ্চিয়ানের কথাগুলো।-প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, বিদ্রোহের কথা ফাঁস করব না ইন্ডিয়ানদের কাছে। তার মানে পালানোর আশা নেই বললেই চলে। বিদ্রোহীরা নিশ্চয়ই চোখ রাখবে আমাদের ওপর। এর পর যদি পালাব না এই প্রতিশ্রুতি চেয়ে বসে।
বাৰ্থে ফিরে স্টুয়ার্টকে একা পেয়ে বললাম ক্রিশ্চিয়ান যা যা বলেছে। শুনেই গম্ভীর হয়ে গেল স্টুয়ার্ট। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, অন্তত পেগির সঙ্গে একবার দেখা করতে পারব তো।
তা বোধ হয় পারবে, যদি প্রতিশ্রুতি দাও।
দেব। পেগিকে এক পলক দেখার জন্যে হলেও দেব। হঠাৎ করেই উঠে পায়চারি শুরু করল স্টুয়ার্ট। আস্তে আস্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর মুখ। বলল, পেগি হয়তো পালানোর ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবে আমাদের।
লাফ দিয়ে উঠলাম আমি। হ্যাঁ পারবে, স্টুয়ার্ট! পারলে ও-ই পারবে। ওর সঙ্গে দেখা হলে এক ফাঁকে জানাবে, চার্চিল যেমন অন্যদের নিয়ে পালিয়েছিল আমরাও তেমনি পালাতে চাই, ও যেন গভীর রাতে একটা বড় ক্যানো নিয়ে চলে আসে জাহাজের কাছে। ক্যানোয় চেপে অন্য কোন দ্বীপে চলে যাব আমরা।
হ্যাঁ, পেগিই আমাদের একমাত্র ভরসা, বলল স্টুয়ার্ট। মাত্র দশটা মিনিট ওর সাথে একা থাকতে পারলে আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলতে পারব। বলব, ক্যানো চালানোর সময় বেশি শব্দ যেন না হয়। অবশ্য হলেও তেমন অসুবিধা নেই। ইন্ডিয়ানরা মাছ ধরার সময় দিন রাতের বাছ বিচার তো করে না। সুতরাং কে সন্দেহ করবে? ডেকে যে পাহারায় থাকবে তাকে বোকা বানানো শক্ত হবে না। নিঃশব্দে আমরা নেমে যাব পানিতে। ডুব সাঁতার দিয়ে ক্যানোর কাছে। পৌঁছুতে পারব সহজেই। তারপর ওটার আড়ালে আড়ালে জাহাজের দৃষ্টিসীমার বাইরে গিয়ে উঠব ক্যানোয়।
হ্যাঁ, স্টুয়ার্ট, আমার বিশ্বাস, পারব আমরা!
পারতেই হবে।
.
জুনের পাঁচ তারিখ বিকেলে আমরা তাহিতির দেখা পেলাম। পরদিন বিকেলে পয়েন্ট ভেনাসের কাছে নোঙ্গর ফেলল বাউন্টি। ইন্ডিয়ানরা ক্যাননীয় চেপে এসে ঘিরে ধরল আমাদের। এত তাড়াতাড়ি আবার আমরা এসেছি দেখে অবাক সবাই। টেইনা, হিটিহিটি, এবং আরও কয়েকজন গোত্রপতি উঠে এল জাহাজে। তাদের মুখে প্রশ্ন, এত তাড়াতাড়ি আমরা ফিরে এলাম কেন। ক্রিশ্চিয়ানের হয়ে জবাব দিলাম আমি। যা বললাম তার মর্মার্থ হলো; আইটুটাকিতে ব্লাইয়ের বাবা মানে ক্যাপ্টেন কুকের সাথে দেখা হয়ে যায় আমাদের। ওই দ্বীপে একটা ইংরেজ উপনিবেশ গড়ে তুলছেন কুক। সেজন্যে ব্লাই, নেলসন এবং আরও কয়েকজনকে নিজের জাহাজে তুলে নিয়েছেন। রুটিফলের চারাগুলোও তিনি রেখে দিয়েছেন, এবং আমাদের পাঠিয়েছেন তাহিতি থেকে আরও খাবার দাবার এবং জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্যে। এবার আমরা বেশির ভাগই জ্যান্ত জীব জানোয়ার নিতে চাই, জানাতে ভুললাম না।