জি, স্যার।
সেক্সট্যান্ট আছে তোমার কাছে
হ্যাঁ। বাবার একটা ছিল, সেটা নিয়ে এসেছি।
ভাল করেছ। ব্লাই যোগ্য নাবিক। সত্যি কথা বলতে কি ওর চেয়ে যোগ্য আর কেউ নেই এখন। ও তোমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে পারবে। ওর নির্দেশ মেনে চললে আমার মনে হয় না, তোমার কোন অসুবিধা হবে। মনে রাখবে-এ ধরনের কাজে শৃঙ্খলার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
স্যার জোসেফের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। কানের ভেতর গমগম করছে ওঁর শেষ কথাগুলো-শৃখলার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি! কতটা যে বেশি তা আমি ভদ্রলোকের সাথে আবার দেখা হওয়ার আগে হাড়ে হাড়েই টের পেয়েছিলাম।
.
দুই
নভেম্বরের শেষ দিকে আমি বাউন্টিতে যোগ দিলাম।
আগেই বলেছি জাহাজটা ছোট। মাত্র নব্বই ফুট লম্বা, চওড়া চল্লিশ ফুট। মাল-বহন ক্ষমতা দুশো টন। তিন বছর আগে হাল-এ তৈরি করা হয়েছে বাণিজ্যিক নৌ-বহরের জন্যে। তখন নাম রাখা হয়েছিল বেথিয়া। সম্প্রতি অ্যাডমিরালটি ওটা কিনে নিয়েছে দুহাজার পাউন্ডের বিনিময়ে। স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস-এর পরামর্শ অনুযায়ী নতুন নামকরণ করা হয়েছে বাউন্টি। বেশ কয়েক মাস ডেন্টফোর্ডের ডকে ছিল। রুটিফুলের চারা বহনের উপযোগী করে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়েছে প্রায় চার হাজার পাউন্ড ব্যয়ে। পেছনের বিরাট কেবিনটা ফাঁকা করে চারা গাছ রাখার জন্যে অসংখ্য মাটির পাত্র সাজানো হয়েছে তাকের ওপর। প্রতিটা পাত্রে যাতে পানি দেয়া যায় তার সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে দীর্ঘ নল লাগিয়ে। ফলে ওপরে ওঠবার মইয়ের দুপাশে দুটো ছোট্ট কুঠুরিতে আশ্রয় নিতে হয়েছে লেফটেন্যান্ট ব্লাই এবং মাস্টার মিস্টার ফ্রায়ারকে।
জাহাজটার পুরো কাঠামো তামার পাত দিয়ে মোড়া, সে যুগের বিচারে নতুন একটা ব্যাপার। তার ওপর পেট মোটা খোল, বেটে মাস্তুল আর মোটাসোটা দড়িদড়া-সব মিলিয়ে বাউন্টিকে দেখতে যতখানি না নৌ বাহিনীর সশস্ত্র জাহাজের মত লাগে তার চেয়ে বেশি লাগে তিমি, শিকারী জাহাজের মত। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ব্যবহার করা যায় এমন একজোড়া কামান বসানো আছে। সামনের দিকে। একই রকম আরও ছটা কামান আছে পেছন দিকে। তা ছাড়াও আছে চারটে চার পাউন্ডার কামান।
জাহাজে পা দিয়েই সব কিছু কেমন অদ্ভুত আর নতুন মনে হলো আমার কাছে। পুরোটা জাহাজ মেয়েমানুষে গিজ গিজ করছে। নাবিকদের স্ত্রীরা বিদায় জানাতে এসেছে স্বামীদের। রাম-এর বন্যা বইছে যেন ডেকের ওপর দিয়ে। নারী-পুরুষের হৈ চৈ, চিঙ্কারে কান পাতা দায়। জেটিতেও অনেক মানুষের জটলা। ওরা দর্শক। হৈ হল্লা করছে ওরাও।
ডেকের নারী পুরুষদের মাঝ দিয়ে পথ করে কোন রকমে জাহাজের পেছন দিকে গেলাম আমি। কোয়ার্টার ডেকে দেখলাম মিস্টার ব্লাইকে। দীর্ঘ, পেটা শরীরের এক লোক তার সামনে।
আমি, স্যার, পোর্টসমাউথ মানমন্দিরে গিয়েছিলাম, লোকটাকে বলতে শুনলাম, আমাদের সময়-রক্ষক এক মিনিট বাহান্ন সেকেন্ড এগিয়ে আছে ঠিক সময় থেকে, এবং দিনে আরও এক সেকেন্ড করে এগিয়ে যাচ্ছে। মিস্টার বেইলি এ ব্যাপারে একটা চিঠি দিয়েছেন আপনাকে।
ধন্যবাদ, ক্রিশ্চিয়ান, ব্যাপারটা দেখছি আমি, বলে ব্লাই ঘাড় ফেরাতেই দেখলেন আমাকে। আহ, মিস্টার বিয়্যাম, তুমি এসে গেছ! বললেন তিনি। এসো পরিচয় করিয়ে দেই, এ হচ্ছে মিস্টার ক্রিশ্চিয়ান, আমাদের মাস্টারের মেট। আর, ক্রিশ্চিয়ান, এ হলো রজার বিয়্যাম, আমাদের নতুন মিডশিপম্যান। রজার, তুমি ক্রিশ্চিয়ানের সঙ্গে যাও, ও তোমার বার্থ দেখিয়ে দেবে, তোমার কাজ সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক ধারণাও পাবে ওর কাছে।
মাথা নুইয়ে ক্রিশ্চিয়ানের পেছন পেছন এগোলাম আমি।
পরের দিনগুলোতে একটু একটু করে বাউন্টির অন্যান্য নাবিকদের সাথে পরিচয় হলো আমার। মাস্টার ফ্রায়ার, সার্জন ওল্ড ব্যাকাস, উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ডেভিড নেলসন, মাস্টার অ্যাট আর্মস চার্লস চার্চিল, সহকারী সার্জন টমাস লেডওয়ার্ড, মাস্টার অ্যাট আর্মস-এর মেট উইলিয়াম এলফিনস্টোন, গোলন্দাজ উইলিয়াম পেকওভার, গোলন্দাজের মেট জন মিলস, সারেং উইলিয়াম কোল, সহকারী সারেং জেমস মরিসন, ছুতোর মিস্ত্রী উইলিয়াম পার্সেল, ছুতোর মিস্ত্রীর দুই সহকারী চার্লস নরম্যান আর টমাস ম্যাকইন্টশ, আর্মারার জোসেফ কোলম্যান, আমার সহযোগী মিডশিপম্যান পাঁচজন-টমাস হেওয়ার্ড, জন হ্যালেট, রবার্ট টিঙ্কলার, এডওয়ার্ড ইয়ং, জর্জ স্টুয়ার্ট; দুই কোয়ার্টার মাস্টার-জন নর্টন আর পিটার লেংকলেটার, সহকারী কোয়ার্টার মাস্টার জর্জ সিম্পসন, পাল নির্মাতা লরেন্স লেবোগ, ক্যাপ্টেনের কেরানী মিস্টার স্যামুয়েল, কসাই রবার্ট ল্যাম্ব, মালী উইলিয়াম ব্রাউন, বাবুর্চি জন স্মিথ আর টমাস হল; দক্ষ খালাসী টমাস বারকিট, ম্যাথ কুইনটাল, জন সামনার, জন মিলওয়ার্ড, উইলিয়াম ম্যাককয়, হেনরি হিব্রান্ডট, আলেকজান্ডার স্মিথ, জন উইলিয়ামস, টমাস এলিসন, আইজাক মার্টিন, রিচার্ড স্কিনার, ম্যাথু থম্পসন, উইলিয়াম মুসাট আর মাইকেল বায়ার্ন-প্রত্যেকে যার যার ক্ষেত্রে দক্ষ। আমি একাই কেবল আনকোরা নতুন।
আটাশ নভেম্বর ভোরে আমরা পাল তুলে দিলাম। তরতর করে এগোল বাউন্টি। কিন্তু কপাল মন্দ, সেন্ট হেলেনস দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছুতেই বাতাস প্রতিকূল হয়ে উঠল। আকাশ হয়ে উঠল মেঘাচ্ছন্ন। বৃষ্টি পড়তে লাগল। নোঙ্গর ফেলা ছাড়া গত্যন্তর রইল না আমাদের।