তুমি যদি রাজি হও আর তোমার মা যদি অনুমতি দেন, আমার দিক থেকে কোন অসুবিধা নেই। আমি বরং খুশিই হব। ইন্ডিয়ানদের ব্যাকরণ তৈরির কাজটা তোমার ঘাড়ে চাপানো যাবে।
মা বসার ঘরে আসতেই আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, মা, লেফটেন্যান্ট ব্লাই বলছেন, আমি ইচ্ছে করলেই আগামী যাত্রায় ওঁর সঙ্গী হতে পারি, তুমি আপত্তি না করলেই হয়।
তাই নাকি? মিস্টার ব্লাই-এর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন মা।
হ্যাঁ, ম্যাডাম।
কিন্তু, ও জাহাজের কি বোঝে?।
বোঝে না, বুঝে নেবে। আপনি চিন্তা করবেন না, ম্যাডাম, আমার বিশ্বাস খুব শিগগিরই আপনার ছেলে ভাল নাবিক হয়ে উঠবে। ওর ভাষাজ্ঞানটাকে আমি কাজে লাগাতে চাই।
কতদিন আপনারা বাইরে থাকবেন?
এই ধরুন দুবছর।
দুবছর। এক মুহূর্ত ভাবলেন মা। তারপর একটু ইতস্তত করে বলে ফেললেন, ঠিক আছে, আপনি যদি মনে করেন ওকে কাজে লাগাতে পারবেন, নিয়ে যান।
কথাবার্তা সব পাকাপাকি হয়ে গেল। ঠিক হলো শিটহেড এ গিয়ে আমি যোগ দেব বাউন্টিতে।
.
অক্টোবরের শেষ দিকে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লন্ডন গেলাম আমি।
প্রথমেই ভাল এক দর্জির দোকানে গিয়ে এক প্রস্থ নাবিকের পোশাকের মাপ দিলাম। আমাদের উকিল মিস্টার একাইনের সাথে দেখা করে কিছু আইনগত বিষয় পাকাপাকি করলাম। তারপর গেলাম বাবার বন্ধু স্যার, জোসেফের সঙ্গে দেখা করতে।
অত্যন্ত সুপুরুষ স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস। ক্যাপ্টেন কুকের বন্ধু, দীর্ঘদিনের সাথী এবং সহযাত্রী। বছর পঁয়তাল্লিশ হবে বয়েস। এ বয়েসেই রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। এ থেকেই অনুমান করা যায় কি গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী তিনি। খাওয়া দাওয়ার পর তার পড়ার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন আমাকে। টেবিলের ওপর থেকে একতাড়া কাগজ তুলে এগিয়ে দিলেন আমার দিকে।
তাহিতিয়ান ভাষার শব্দ-কোষ, বললেন তিনি। তোমাকে দেব বলে নকলটা তৈরি করে রেখেছি। খুবই সংক্ষিপ্ত আর অসম্পূর্ণ। আশা করছি যদ্র সম্ভব এটা সম্পূর্ণ করবে তুমি। উচ্চারণগুলো আরও ভাল করে শুনে ঠিক বানানে লিখবে। আমার ধারণা-ব্লাইও আমার সাথে একমত, ইটালিয়ানদের বানান পদ্ধতি অনুসরণ করে লিখলে কাজটা সহজ হবে! ইটালিয়ান তো জানো তুমি, তাই না?
হ্যাঁ, স্যার।
বেশ, বলে চললেন স্যার জোসেফ, কয়েক মাস লাগবে ওদের ৮ রুটিফলের চারা সংগ্রহ করতে। সেই সময়টা তুমি ব্যয় করবে অভিধানের কাজে। তোমাকে যেন অন্য বিষয়ে মাথা ঘামাতে না হয় তা দেখবে ব্লাই। তুমি ফিরলেই আশা করি আমি এটা প্রকাশ করতে পারব। তাহিতিয়ানেরই বিভিন্ন উপভাষায় কথা বলে বিস্তীর্ণ দক্ষিণ সাগরীয় দ্বীপরাশির মানুষ। অভিধানটা তৈরি করা গেলে নাবিকদের কত উপকার হবে বুঝতে পারছ? সহজেই ওরা আলাপ করতে পারবে স্থানীয়দের সাথে।
তাছাড়া আমার বিশ্বাস, একটু থেমে বলে চললেন স্যার জোসেফ, খুব শিগগিরই ওই দ্বীপগুলোর ওপর চোখ পড়বে আমাদের খামার মালিকদের। আমেরিকার উপনিবেশগুলো হাতছাড়া হওয়ার পথে, সুতরাং আজ হোক কাল হোক, ওদিকে ওদের নজর দিতে হবেই। স্থানীয় ভাষার অভিধান, ব্যাকরণ হাতের কাছে থাকলে কত সুবিধা হবে ওদের ভাবতে পারো?
একটা ব্যাপার খেয়াল রাখবে, কাজ যেটুকু করবে নিখুঁত ভাবে করবে। আর নিখুঁত কাজ করতে হলে একজন ভাল তাইও–মানে বন্ধু বেছে নিতে হবে তোমাকে। মাতাভাই উপসাগরে যখন কোন জাহাজ নোঙ্গর ফেলে, হাজার হাজার ইন্ডিয়ান ক্যানো নিয়ে হাজির হয় সেখানে। সাদা মানুষদের বন্ধু হওয়ার জন্যে উদগ্রীব থাকে সবাই। ওই সময় তোমাকে সাবধান হতে হবে। বন্ধুত্ব করতে হবে সুতরাং একজনের সাথে করলেই হলো, এ মনোভার ভুলেও আমল দেবে না। তীরে নেমে আগে ভাবচাল বুঝবে, লোকজনের সাথে আলাপ করবে, তারপর যাকে মনে হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমান, উঁচু শ্রেণীর, তাকেই তুমি তাইও হিসেবে নেবে। সাধারণ দুএকটা জিনিস-যেমন, ছুরি, কাঁচি, কুঠার এসবের বিনিময়ে পাবে তাজা খাবার, আতিথেয়তা, উপহারমোট কথা ওদের পক্ষে যা দেয়া সম্ভব সবই তোমাকে দেবে। নিচু শ্রেণীর কাউকে তাইও হিসেবে নিলে পুরো পরিশ্রমটাই পণ্ড হবে। দেখবে, বুদ্ধিশুদ্ধি নেই লোকটার, যেটা তোমার সবচেয়ে বেশি দরকার, হয়তো দেখবে সেটাই সে ঠিক মত জানে নামানে ভাষা, উচ্চারণ ঠিক নেই, এমনি সব ব্যাপার। আমার ধারণা এই লোকগুলো শুধু যে অন্য শ্রেণীর তা-ই না, অন্য গোত্রেরও বটে। আমার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, লম্বা চওড়া সুন্দর চেহারার তাহিতিয়ানরাই বুদ্ধিমান হয় বেশি?
মানে আপনি বলতে চাইছেন, আমাদের ভেতর যেটুকু সামাজিক সাম্য আছে ওদের ভেতর তারচেয়ে বেশি কিছু নেই।
হাসলেন স্যার জোসেফ। আমি বলব কম। ওপরে ওপরে মনে হয় ওরা সবাই সমান, সব শ্রেণীর মানুষ একই কাজ করে, হয়তো দেখবে মাছ ধরা দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে রাজা, বা রানী নিজের ক্যানো নিজেই বেয়ে চলেছে বা অন্য মেয়েদের সাথে বসে বাকল-এর কাপড় তৈরি করছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় ওরা সমান। যতই যোগ্যতা বা বুদ্ধির পরিচয় দিক না কেন, ওদের সমাজে যে যে স্তরে জন্মেছে তা থেকে ওপরে উঠতে পারে না। ওদের বিশ্বাস কেবল গোত্রপ্রধানদেরই আত্মা আছে কারণ তারা সাক্ষাৎ দেবদেবীর বংশধর। থেমে কয়েক মুহূর্ত চেয়ারের হাতলে তবলা বাজালেন স্যার জোসেফ। তারপর প্রশ্ন করলেন, তোমার যা যা দরকার সব জোগাড় হয়ে গেছে? কাপড় চোপড়, লেখার সরঞ্জাম, টাকা?