হিটহিটিকে দেখে পথ করে দিল কিছু দর্শক। মঞ্চের একেবারে সামনে। গিয়ে বসলাম আমরা। ভঁড় দুজন নেমে যাওয়ার পর মঞ্চে উঠল দুজন তরুণী, সঙ্গে চার টুলী। ঢোলের তালে তালে নাচতে লাগল তারা। অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি। কোন কোনটা তো রীতিমত অশ্লীল মনে হলো। হিটিহিটি আমার কানে কানে জানাল জমির উর্বরা শক্তি বাড়ানোর জন্যে নাচা হয় এই নাচ।
অবশেষে শেষ হলো ছয় তরুণীর উন্মাদ উদ্দাম নৃত্য। মঞ্চ এখন শূন্য। আমার তাইও বলল, এবার নাকি সম্পূর্ণ অন্য ধরনের একটা নাচ হবে।
দর্শকদের মাঝ দিয়ে এগিয়ে এল নাচের দ্বিতীয় দলটা। দুজনের দল। প্রতিটি মেয়ের সঙ্গে দুজন করে বৃদ্ধা আর একজন ঘোষক। ঘোষকরা একে একে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করতে লাগল নর্তকীদের নাম এবং পদবী, এক এক করে মঞ্চে উঠল দুই মেয়ে। বৃদ্ধারা রইল নিচে। একই রকম সাজসজ্জা করেছে দুটি মেয়ে। তুষারধবল টাপা কাপড়ের পোশাক, মাথায় টামাউ নামের বিচিত্র এক ধরনের সাজ। হাতে ছোট হাত পাখা, অদ্ভুত ভাবে বাঁকানো সেগুলোর হাতল। শুধু এ-ই না, নানা ধরনের স্থানীয় প্রসাধনী মেখে উজ্জ্বল করা হয়েছে চোখ, গাল, তুক-মোটকথা সৌন্দর্য।
দ্বিতীয় মেয়েটা মঞ্চে উঠতেই একটু যেন থমকালাম আমি। সেই মেয়েটা-পইনের আত্মীয়া; অভিজাত ইন্ডিয়ানরা সচরাচর যেমন হয়, সাধারণদের চেয়ে এক মাথা উঁচু। সন্ধ্যায় খাওয়ার সময় এক পলক দেখে বুঝতে পারিনি ওর সৌন্দর্য। এখন পারলাম। অপূর্ব মুখশ্রী আর দেহের গঠন। দক্ষ কোন শিল্পীর হাতে গড়া যেন। এমন রূপ ইউরোপীয় মেয়েদের মধ্যেও খুব কমই দেখা যায়। ঘোষক যতক্ষণ তার দীর্ঘ নাম, এবং আরও দীর্ঘ পদবীর তালিকা ঘোষণা করল ততক্ষণ সে নত মুখে গর্বিত অথচ বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল আমাদের মুখোমুখি। এত লম্বা নাম আর পদবীর কিছুই আমি বুঝতে পারব না অনুমান করে হিটিহিটি একটু ঝুঁকে নিচু কণ্ঠে ওর ডাক নামটা জানাল আমাকে।
তেহানি, বলল সে, অর্থাৎ সুপ্রিয়। মনে মনে বললাম, যোগ্য নামই বটে।
দুজনের নাচ বুরা। দুই ঘোষক মঞ্চ থেকে নেমে যেতেই নাচ শুরু করল তেহানি আর অন্য মেয়েটা। ধীর লয়ে বাজছে ঢাক আর স্থানীয় এক ধরনের বাঁশি। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুলছে দুই তরুণী। কি অপূর্ব দেহ ভঙ্গিমা, বাহুর সঞ্চালন, বঙ্কিম গ্রীবার নড়াচড়া! মুগ্ধ হয়ে দেখলাম আমি।
তেহানি আর তার সঙ্গিনী নেমে যাওয়ার পর মঞ্চে এল দুই ভাড়। আবার হাসির হররা উঠল দর্শকদের ভেতর। ইতোমধ্যে তৈরি হতে লাগল বুরা নাচের পরবর্তী জোড়া। কিন্তু আমার মন আর অনুষ্ঠানের দিকে নেই, বাসায় ফেরার জন্যে ব্যস্ত সে তখন; নিশ্চিত জানে, নাচ শেষে সেখানেই গেছে তেহানি।
অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেই প্রায় জোর করে হিডিহিটিকে উঠিয়ে নিয়ে ফিরে এলাম পইনোর বাসায়। কিন্তু তেহানিকে দেখার সৌভাগ্য আর হলো না। দুই বৃদ্ধার পাহারায় আলাদা একটা ঘরে শুয়ে পড়েছে সে।
.
সূর্যোদয়ের ঘণ্টা দুয়েক পরে আমরা রওনা হলাম টেতিয়ারোয়া থেকে। সেদিনই দুপুরে মিস্টার ব্লাইকে জানালাম আমার অভিযানের ফলাফল। পরবর্তী তিন সপ্তাহ পলাতকদের কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। তারপর নিজেরাই এসে ধরা দিল তারা। আমি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পর সব ইন্ডিয়ান গোত্রপতিকে ডেকে ব্লাই অনুরোধ করে বলেছিলেন, তারা যদি পলাতক তিন বদমাশকে ধরে দেয়ার ব্যাপারে সাহায্য করে, তিনি খুব খুশি হবেন, ইংল্যান্ডে রাজা জর্জও খুশি হবেন। রাজা জর্জ খুশি হবেন শুনে সাহায্য করতে রাজি হয়েছিল গোত্রপতিরা। এবং সবাই যার যার প্রজাদের নির্দেশ দিয়েছিল, তিন পলাতককে দেখা মাত্র যেন ধরে নিয়ে আসে। ফলে চার্চিল, মুসাট আর মিলওয়ার্ড কোথাও একদিনের বেশি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেনি। ইন্ডিয়ানরা ওদের খবর পাওয়া মাত্র দলে দলে গিয়ে ধাওয়া করে, আর ওরা পালায়। এভাবে সপ্তাহ তিনেক কাটানোর পর আত্মসমর্পণ না করে পারেনি ওরা।
তিন জনকেই চাবকানো হলো-চার্চিলকে দুজন আর মুসভ্যাট ও মিলওয়ার্ডকে চার ডজন করে।
.
মার্চ-এর শেষ দিকে আমি-আমার সতীর্থ নাবিকরাও-মোটামুটি আন্দাজ করতে পারলাম, বাউন্টির যাত্রা করার সময় কাছিয়ে এসেছে। এক হাজারেরও বেশি রুটিফলের চারা যোগাড় হয়েছে, সেগুলো জাহাজে তোলাও হয়ে গেছে। এখন বাউন্টির পেছন দিককার বড় কেবিনটায় ঢুকলে মনে হয় কোন বোটানিক্যাল গার্ডেনে এসে পড়েছি।
যাত্রার অন্যান্য আয়োজন সম্পন্ন প্রায়। প্রচুর শুয়োরের মাংস নুন দিয়ে নেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও নেয়া হয়েছে বিপুল পরিমাণ ইয়াম (এক ধরনের আলু)। একমাত্র ব্লাই জানেন কখন আমরা পাল তুলে দেব। তবে এটুকু স্পষ্ট, রওনা হওয়ার দিন আর বেশি দূরে নয়।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, তাহিতি ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে মনের ভেতর খুব একটা তাড়া অনুভব করছি না আমি। হিটিহিটি আর ওর পরিবারের সাথে একাত্ম হয়ে গেছি এই কমাসে। ওরা আমার আত্মীয় হয়ে উঠেছে যেন। দেশে যদি মা না থাকত আর বলা হত বাকি জীবন আমাকে এই আধা সভ্য আধা অসভ্যদের দেশে কাটাতে হবে, খুশি মনেই আমি মেনে নিতমি প্রস্তাবটা।
এখন আমি স্থানীয় ভাষায় মোটামুটি আলাপ চালাতে পারি। যদিও জানি এই মোটামুটিটাকে পুরোপুরিতে পরিণত করতে হলে বহু বছরের সাধনার প্রয়োজন, কিন্তু সেই সাধনার সময় আমি পাব না-অন্তত এখন নয়। ইংল্যান্ডে গিয়ে স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কসকে জানাতে হবে আমার কাজের ফলাফল, তারপর স্যার জোসেফ চাইলে আবার আমি আসব। যদি জানতাম আগামী ছমাস বা এক বছরের ভেতর ইংল্যান্ড থেকে আরেকটা জাহাজ তাহিতিতে আসবে তাহলে হয়তো কাজ শেষ করার জন্যে আমাকে রেখে যাওয়ার অনুরোধ করতাম মিস্টার ব্লাইকে। কিন্তু জাহাজ তাহিতিতে আসবেই এ মুহূর্তে এমন নিশ্চয়তা দেয়ার কেউ নেই হাতের কাছে। সুতরাং মনে মনে প্রস্তুত হলাম কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই তাহিতি ছেড়ে যাওয়ার জন্যে।