ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে নিচে নামলাম আমি। স্টুয়ার্ট আর টিঙ্কলারকে দেখলাম বার্থে।
খবরটা শুনেছ নিশ্চয়ই? জিজ্ঞেস করল স্টুয়ার্ট।
হ্যাঁ, ক্যাপ্টেনের মুখেই শুনলাম। মজার কথা কি জানো, ওদের ধরে আনার দায়িত্ব চেপেছে আমার ঘাড়ে।
বেচারা! জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করল স্টুয়ার্ট।
কাটার নিয়ে পালাল কি করে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ডেক পাহারায় ছিল হেওয়ার্ড। বেটা গর্দভ ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভোরে উঠে দেখে কাটার নেই, আমাদের তিনজন নাবিকও নেই। ওই, ব্লাই যে কি খ্যাপা খেপেছিল, যদি দেখতে! এক মাস ওকে শিকলে আটকে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
ঘণ্টাখানেকের ভেতর হিটিহিটির বাড়িতে পৌঁছে গেলাম আমি। বাড়িতেই পেলাম ওকে। ক্যাপ্টেনের হয়ে ওর বড় ক্যানোটা ধার চাইলাম। কয়েকজন লোকও চাইলাম ক্যানো চালানোর জন্যে। কি কারণে কোথায় যাব বললাম। তক্ষুণি বারো জন লোক সহ ক্যানোটা দিতে রাজি হয়ে গেল হিটিহিটি। এবং জানাল ও নিজেও যাবে আমার সাথে। আপত্তি করার কোন কারণ দেখলাম না। হিটিহিটির মত একজন গোত্রপতি সঙ্গে থাকলে সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা টেতিয়ারোয়ায় বিশেষ খাতির যে পাব তাতে সন্দেহ নেই।
দুপুর দুটো নাগাদ আমরা রওনা হয়ে গেলাম।
তাহিতির মাইল ত্রিশেক উত্তরে পাঁচটা নিচু প্রবাল দ্বীপের সমষ্টি টেতিয়ারোয়া, এ অঞ্চলের গোত্রপতিদের অবকাশ যাপন কেন্দ্র। দ্বীপগুলোকে বেষ্টন করে আছে নিচু একটা প্রবাল প্রাচীর। অর্থাৎ চমৎকার একটা লেগুনের মাঝখানে দ্বীপ পাঁচটার অবস্থান। লেগুনের ভেতর স্বচ্ছ টলটলে সাগর শান্ত। এই ছোট্ট দ্বীপপুঞ্জের মালিক তাহিতির সবচেয়ে বড় গোত্রপতি টেইনা। টেইনা তো বটেই, তাহিতি এরং আশপাশের দ্বীপগুলোর অন্যান্য গোত্রপতিরাও বছরে এক বা দুমাস কাটিয়ে যায় এখানে। অভিজাত পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে স্বাস্থোদ্ধারের জন্যেও এখানে নিয়ে আসা হয়।
খুবই দ্রুতগামী হিটিহিটির ক্যানোটা। গতি কম পক্ষে ঘন্টায় বারো নট, মানে বাউন্টির প্রায় দ্বিগুণ। আড়াই ঘণ্টাও লাগল না আমাদের টেতিয়ারোয়া লেগুনে পৌঁছুতে। দেখতে দেখতে ছোট ছোট ক্যানো আর নগ্নদেহী সাঁতারুর দল ঘিরে ধরল আমাদের।
একটু চটপটে আর বয়স্ক একজনকে লক্ষ করে আমার হয়ে হিটিহিটি প্রশ্ন করল, পিরিতেন-এর তিনজন সাদা মানুষ ওদের দ্বীপে এসেছে কি না, যদি এসে থাকে তাহলে এখন তারা কোথায়।
লোকটা জবাব দিল, হ্যাঁ, তিন জন সাদা-মানুষ এসেছিল, তবে রেশিক্ষণ থাকেনি এখানে। আরও সাদা মানুষ পিছু ধাওয়া করে আসতে পারে ভেবে চলে গেছে। সে দুতিন ঘন্টা আগের কথা।
কোথায় গেছে জানো নাকি? হিটিহিটি জিজ্ঞেস করল।
না, তবে দেখলাম পশ্চিম দিকে গেল।
আমার মনে হয় এইমিওতে গেছে ওরা, পাশ থেকে এক সাঁতারু বলে উঠল।
হতে পারে, আগের লোকটা বলল। তাহিতির পশ্চিম তীরেও যেতে পারে।
সন্ধ্যা হতে বিশেষ বাকি নেই, বাতাসও পড়ে আসছে ধীরে ধীরে (দক্ষিণ সাগরীয় অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যই এই, শেষ বিকেল থেকে বাতাস পড়তে থাকে, সন্ধ্যা হতে হতে থেমে যায় একেবারে। তাছাড়া চার্চিল ও তার দুই সঙ্গীর গন্তব্যও নিশ্চিত ভাবে জানা যাচ্ছে না; সব দিক বিবেচনা করে হিটিহিটি বলল, রাতটা টেতিয়ারোয়ায় কাটিয়ে দেই, কি বলো, বিয়্যাম? কাল ভোরে বাতাস উঠলে আবার রওনা হওয়া যাবে।
এর চেয়ে ভাল প্রস্তাব আর হতে পারে না। সুতরাং রয়ে গেলাম টেতিয়ারোয়ায়।
প্রবাল দ্বীপে সে রাতটার কথা আমি জীবনে ভুলব না। আগেই বলেছি টেতিয়ারোয়া এ অঞ্চলের গোত্রপতিদের অবকাশযাপনকেন্দ্র; সে কারণে বছরের প্রায় সব সময়েই কোন না কোন গোত্রপতি এখানে থাকে। কখনও কখনও এক সাথে তিন চারজনও থাকে। এখন আছে তিন জন। হিটিহটি আসায় হয়েছে চারজন। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো পইনো নামের এক বিখ্যাত যোদ্ধার বাসায়। পইনো এসেছে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্যে। অত্যধিক আভা (এক ধরনের স্থানীয় মদ পান করে মরতে বসেছিল বেচারা। মাদুরের ওপর শুয়ে থাকতে দেখলাম ওকে, নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই বললেই চলে, গায়ের চামড়া তুঁতের মত নীল। দেখে আমার দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। হিটিহিটি অবশ্য বলল, মাসখানেকের মধ্যে ও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে।
পইনোর সেবা শুশ্রষার জন্যে এসেছে ওর বেশ কয়েকজন আত্মীয়। এক তুরুণী আছে তাদের ভেতর। অপূর্ব সুন্দরী। তাইয়াপুর নাম করা ভেহিয়াটুয়া পরিবারের মেয়ে সে। দুই বৃদ্ধা মহিলা আছে তার দেখাশোনার জন্যে। খাওয়ার সময় দূর থেকে এক পলক দেখলাম মেয়েটাকে। এরপর দেখতে ইচ্ছে হওয়া সত্ত্বেও রাতে হেইভার (এক ধরনের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান) আগে আর ওর দেখা পেলাম না।
সন্ধ্যার পর বেড়াতে বেরোলাম আমি আর হিটিহিটি। নারকেল বীথির মাঝ দিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটার পর দূর থেকে ভেসে এল ঢাকের আওয়াজ। আরও কিছু
দূর এগিয়ে দেখতে পেলাম মশালের আলো। আমার তাইওর হাঁটার গতি দ্রুত। হয়ে গেল। সামনে বিরাট এক টুকরো সমতল ফাঁকা জায়গার এক প্রান্তে ঘষে ঘষে চারকোনা করা প্রবালের টুকরো সাজিয়ে একটা মঞ্চ মত তৈরি করা হয়েছে। তার সমনে বসে আছে কম পক্ষে দুতিনশো দর্শক। নারকেল পাতার, মশাল জ্বেলে উজ্জ্বল আলোকিত করে তোলা হয়েছে জায়গাটা। আমরা যখন সেখানে পৌঁছলাম তখন দুই ভাড়-স্থানীয় ভাষায় ফাআতা-অভিনয় কুশলতার প্রমাণ দিয়ে বিদায় নিচ্ছে। হাসির ঝড় বয়ে যাচ্ছে দর্শকদের ভেতর।