সারাটা দিন টগবগে উত্তেজনায় কাটালাম আমি। ক্যাপ্টেন কুকের একজন সহযাত্রী আমাদের বাড়িতে আসছেন। দক্ষিণ সাগর, তার দ্বীপরাশি, সেসব দ্বীপের সুখী মানুষগুলো সম্পর্কে এতদিন কেবল বইয়েই পড়েছি। আজ একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা শুনতে পাব। উত্তেজিত হওয়ার মত ব্যাপারই বটে।
সন্ধ্যার সামান্য আগে গাড়ি এসে দাঁড়াল আমাদের বাড়ির সামনে। কোচোয়ান লাফিয়ে নেমে দরজা মেলে ধরল। মিস্টার ব্লাই নেমে এলেন। দুরু দুরু বুকে আমি অপেক্ষা করছিলাম তাকে স্বাগত জানানোর জন্যে। এগিয়ে যেতেই তিনি মৃদু হেসে উষ্ণ করমর্দন করলেন আমার সাথে। বললেন, একেবারে বাপের চেহারা পেয়েছ! ওঁর মারা যাওয়া-সত্যিই বিরাট ক্ষতি, অন্তত যারা নৌবিদ্যার চর্চা করে তাদের কাছে।
লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ব্লাই মাঝারি গড়নের মানুষ। ঋজু শক্তপোক্ত শরীর। একটু মোটা। পোড় খাওয়া চেহারা। দৃঢ় চোয়াল। কপালের নিচে সুন্দর কালো একজোড়া চোখ। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, বেশির ভাগই ঢাকা পড়ে গেছে নাবিকদের তিন কোনাওয়ালা টুপির নিচে। পরনে নাবিকদের উর্দি, সাদা কিনারাওয়ালা উজ্জ্বল নীল কোট, সাদা ওয়েস্টকোট, ব্রিচেস আর মোজা।
বসার ঘরে নিয়ে বসালাম মিস্টার ব্লাইকে। একটু পরেই মা নেমে এলেন ওপর থেকে। খাওয়ার টেবিলে গিয়ে বসলাম আমরা। খেতে খেতে আলাপ চলল। দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ের ব্যাপারে আমার বাবা যে পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন ব্লাই। নাবিকদের যে কতটা সুবিধা হয়েছে তা বললেন। তারপর একসময় উঠল দক্ষিণ সাগর প্রসঙ্গ।
ক্যাপ্টেন কুকু যেমন বলেছেন, তাহিতির ইন্ডিয়ানরা সত্যিই সেরকম সুখী নাকি? মা জিজ্ঞেস করলেন।
তাহিতির ইন্ডিয়ানদের বেঁচে থাকার জন্যে খুব একটা পরিশ্রম করতে হয়, বললেন আমাদের অতিথি, এটাকে যদি সুখ বলেন তাহলে ওরা সুখী।
রজার আর আমি সেদিন জাঁ জ্যাক রুশোর লেখা পড়ছিলাম, মা বললেন। ওঁর মতের সাথে আমরা একমত, প্রকৃতির সান্নিধ্যেই মানুষ সত্যিকারের সুখী হতে পারে।
মাথা ঝাঁকালেন ব্লাই। হ্যাঁ, রুশোর অভিমত সম্পর্কে শুনেছি আমি, যদিও পড়ার সৌভাগ্য হয়নি-আমি ফ্রেঞ্চ জানি না। আমি কিন্তু একমত নই ভদ্রলোকের সাথে। আমার বিশ্বাস সুখল, শিক্ষার আলো পাওয়া মানবগোষ্ঠিই কেবল প্রকৃত সুখের সন্ধান পেতে পারে। তাহিতির ইন্ডিয়ানদের কথা ধরুন, খাওয়া পরার কোন চিন্তা ওদের নেই, তা সত্ত্বেও ওদের সমাজে এমন সব অদ্ভুত বিধিনিষেধ আছে, তা-ও আবার একটা দুটো নয় হাজার হাজার, অত বিধিনিষেধ মেনে কোন সভ্য মানুষের পক্ষেই জীবনধারণ সম্ভব নয়। মঁসিয়ে রুশো ওদের ভেতর কিছুদিন থেকে এলে নিশ্চয়ই মত বদলাতেন। থেমে হঠাৎ করেই আমার দিকে ফিরলেন মিস্টার ব্লাই। তুমি তাহলে ফ্রেঞ্চ জানো?
হ্যাঁ, স্যার।
শুধু ফ্রেঞ্চ না, মিস্টার ব্লাই, মা বলে উঠলেন, ইটালিয়ানও জানে। এখন শিখছে জার্মান। গত বছর ল্যাটিনে কৃতিত্ব দেখিয়ে পুরস্কার পেয়েছে। আমার কি মনে হয় জানেন?-ভাষা শেখার ব্যাপারে প্রকৃতিদত্ত কিছু গুণ আছে ওর।
এই গুণটা আমি পেলে-উহ! হাসলেন ব্লাই। কি এক ঝামেলার কাজ যে আমার ঘাড়ে চাপিয়েছেন স্যার জোসেফ, যদি জানতেন!
কেন? কি হয়েছে? এক সাথে প্রশ্ন করলাম আমি আর মা।
খুব শিগগিরই আবার দক্ষিণ সাগরের দিকে যাত্রা করছি আমি। বাউন্টি নামের ছোট্ট একটা জাহাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমাকে। তাহিতি থেকে কয়েক হাজার রুটিফলের চারা সগ্রহ করে পৌঁছে দিতে হবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বীপগুলোয়।
আগ্রহেচকচক করে উঠল মায়ের চোখ। উহ, আমি যদি পুরুষ মানুষ হলাম আমাকে সাথে নেয়ার অনুরোধ করতাম. আপনাকে! চারাগুলোর যত্ন নিতে পারতাম আমি।
মৃদু হাসলেন ব্লাই। খুশি হয়েই আমি সঙ্গে নিতাম আপনাকে। যদিও » আমার সাথে একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী যাচ্ছেন, তবু আপনাকে পেলে আপনাকেই আমি নিতাম। ডেভিড নেলসন অবশ্য মোগ্য লোক, চারাগুলোর অযত্ন হবে না এ বিশ্বাস আমার আছে। আমার যেটা দুশ্চিন্তা সে হলো স্যার জোসেফের চাপানো কাজটা।
কি কাজ সেটা? আবার প্রশ্ন করলাম আমি আর মা।
ইন্ডিয়ানদের রীতিনীতি এবং ভাষা সম্পর্কে যতখানি, সম্ভব জ্ঞান অর্জন করে আসতে বলেছেন আমাকে। শুধু এ-ই না, ওদের ভাষায় যত শব্দ আছে তার একটা তালিকা তৈরি করতে হবে, সম্ভব হলে ওদের ভাষার ব্যাকরণও তৈরি করতে হবে। বলুন তো, আমার মত মানুষ নিজের ভাষার বাইরে আর কোন ভাষাই ভাল করে বুঝি না, কি করে এমন গুরুদায়িত্ব পালন করব?
কোন পথে আপনারা যাবেন, স্যার? আমি প্রশ্ন করলাম। হর্ন অন্তরীপ ঘুরে?
সে চেষ্টাই করব, যদি আবহাওয়া অনুকূল থাকে। ফেরার সময় অবশ্য পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ হয়ে উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে আসব।
খাওয়া হয়ে গেছে। টেবিল ছেড়ে উঠে বসার ঘরে গিয়ে বসলাম আমি আর ব্লাই। মা চলে গেলেন রান্নাঘরে টুকিটাকি কাজকর্ম সারতে.। মদের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে ব্লাই আমার ভাষাজ্ঞান সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে লাগলেন। অবশেষে সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, তোমাকে যদি আমি সাথে নিতে চাই, যাবে?
আমার অবস্থা তখন রীতিমত লাফিয়ে ওঠার মত। রুদ্ধশ্বাসে বললাম, সত্যি বলছেন! আমাকে নিয়ে যাবেন?