তক্ষুণি একটা ক্যানো জলে ভাসানো হলো আমার সব মালপত্র:বাউন্টি থেকে নিয়ে আসার জন্যে। সে রাত থেকেই আমি ঘুমাতে লাগলাম আমার নতুন বন্ধু মাহিনা ও আহেনু গোত্রের প্রধান এবং ফারেরোই মন্দিরের বংশানুক্রমিক প্রধান পুরোহিত হিটিহিটিতে-আতুয়াই-ইরি-হাউ-এর বাড়িতে।
.
পাঁচ
তীরে কিছু সময় কাটিয়ে জাহাজে ফিরে গেলেন ব্লাই। আমার হাত ধরে নিজের বাড়ির পথে এগোল আমার তাইও।
পয়েন্ট ভেনাস হয়ে দ্বিতীয় একটা লম্বা অর্ধচন্দ্রাকার সৈকত ঘুরে পুব দিকে কিছুদূর যাওয়ার পর সাগর তীরে সবুজ ঘাসে ছাওয়া এক টুকরো জমির ওপর হিটিহিটির বাড়ি। তীর থেকে কয়েকশো গজ মাত্র দূরে ছোট্ট একটা প্রবাল প্রাচীর খোলা সাগর থেকে আড়াল করে রেখেছে জায়গাটাকে। প্রবাল প্রাচীর আর সবুজ জমিটুকুর মাঝখানে একটা লেগুন। উষ্ণ নীল জল সেখানে। বাতাসের মত পরিচুর। গভীরতা দুই কি তিন ফ্যাদম হবে খুব বেশি হলে।
হিটিহিটির বাড়িটা চমৎকার-অবশ্যই আর দশটা তাহিতীয় বাড়ির তুলনায়। লম্বায় ষাট ফুট মত, চওড়ায় বিশ ফুট। বিরাট দোচালা। ঘাসের ছাউনি। প্রান্ত দুটো অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে যাওয়ায় ডিম্বাকৃতি চেহারা নিয়েছে ঘরটা। সামনে পরিষ্কার নিকানো উঠান। আমরা সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই এক দঙ্গল ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ঘিরে ধরল আমার তাইওকে। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে হিটিহিটি বলল:
আমার নাতি-নাতনী।
হিটিহিটির বয়েস খুব বেশি হলে পঞ্চাশ। এই বয়েসে এতগুলো নাতি নাতনীর দাদা বা নানা হতে পারা কম সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়। কয়েকটা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে পা বেয়ে উঠে গেল ওর কাঁধে। বাকিরা কৌতূহলী চোখে নিরীক্ষণ করছে আমার অদ্ভুত পোশাক আশাক।
বাচ্চাদের হৈ-চৈ শুনে ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের সুন্দরী এক মেয়ে। দুধে আলতা গায়ের রঙ, অপূর্ব দেহবল্লরী। সবচেয়ে আশ্চর্য যেটা, মেয়েটার চোখ দুটো নীল! কোন অইউরোপীয় মেয়ের চোখ এমন নীল হতে পারে আমার ধারণা ছিল না। পরে জেনেছিলাম মেয়েটা বিবাহিতা এবং দুসন্তানের জননী। হিটিহিটি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে মেয়ের দিকে ফিরল।
ও হিনা, পরিচয় করিয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে শুরু করল সে। তারপর একটানা বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে গেল। তাইও শব্দটা উচ্চারণ করতে শুনলাম কয়েকবার এছাড়া আর একটা কথাও আমি বুঝলাম না। বাবার কথা শেষ হতেই হিনা এগিয়ে এসে আমার সাথে করমর্দন করল, আমার গালে নাক ঠেকিয়ে লম্বা করে শ্বাস টানল, হিটিহিটি যেমন করেছিল। তারপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে, খাবার আয়োজনের কতদূর তার খোঁজ খবর করতে।
এই সময় ঘর থেকে বেরিয়ে এল আরেকটা মেয়ে। হিনার চেয়ে সুন্দরী। বছর সতেরো হবে বয়েস। চেহারায় আচরণে গর্বিত ভঙ্গি। নাম মাইমিতি। হিটিহিটি আমার পরিচয় দিতেই হিনার মত মাইমিতিও করমর্দন করে, গালে নাক ঘষে অভিবাদন জানাল আমাকে। ইতোমধ্যে হিনা ফিরে এসেছে। মাইমিতির সাথে আমার পরিচয় পর্ব শেষ হতেই সে জানাল, খাবার তৈরি, এখন খেতে বসলেই হয়। মাথা ঝাঁকিয়ে আমার হাত ধরে খাওয়ার ঘরের দিকে এগোল হিটিহিটি।
প্রায় একশো গজ দূরে ঝোঁপ ঝোঁপ মত হয়ে থাকা কতগুলো লোহা গাছের নিচে একটা ভোলা একচালায় হিটিহিটির খাওয়ার ঘর। পাশেই রান্না ঘর। কোন মহিলা নেই সেখানে। হিটিহিটির বঁধুনিরা সবাই পুরুষ। খাবার ঘরের আঙিনা পর্যন্ত আমাদের পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেল হিনা আর মাইমিতি। পুরুষদের খাওয়ার ঘরে প্রবেশাধিকার নেই ওদের, এমনকি উপস্থিত থাকা পর্যন্ত নিষিদ্ধ।
তাহিতির পুরুষরা মেয়েদের সঙ্গ খুবই পছন্দ করে। সমাজে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা আছে মেয়েদের, স্বাধীনতাও পুরুষের প্রায় সমান, তবু ইন্ডিয়ানরা বিশ্বাস করে পুরুষরা আকাশ অর্থাৎ স্বর্গ থেকে এসেছে আর নারীর জন্ম পৃথিবীতে। পুরুষরা, অর্থাৎ পবিত্র আর নারী নোয়া, অর্থাৎ সাধারণ। গুরুত্বপূর্ণ দেব-দেবীদের মন্দিরে ঢোকা দূরের কথা, পা রাখাও নারীদের জন্যে নিষিদ্ধ। এই একই কারণে পুরুষের সঙ্গে এক সাথে বসে খাওয়াও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নারীর জন্যে। পুরুষের রান্নাটা পর্যন্ত করার অধিকার দেয়া হয়নি নারীকে। এই একটা ব্যাপার ছাড়া আর কোন ক্ষেত্রে নারী পুরুষে কোন ভেদ নেই তাহিতীয় সমাজে।
মুখোমুখি খেতে বললাম আমি আর হিটিহিটি। পরিবেশনের দায়িত্বে আছে একাধিক ভৃত্য। শুরুতেই পানিভর্তি দুটো নারকেলের মালা নিয়ে এল একজন। হাত এবং মুখ ধুয়ে নিল আমার তাইও! দেখাদেখি আমিও ধুলাম। এর পর শুরু হলো খাবার দেয়া। প্রথম পরিবেশিত হলো ঝলসানো মাছ, সঙ্গে রান্না করা কলা। এর পর একে একে এল শুয়োরের মাংস, নিরামিষ তরকারি, পুডিং-এর মত এক ধরনের খাবার। এ ছাড়াও দেয়া হলো চালের তৈরি এক ধরনের চাইনি আর ডাবের মিষ্টি সর।
সত্যিই চমৎকার রান্না হিটিহিটির রাধুনিদের। তাছাড়া গত কয়েকটা মাস বাউন্টিতে, সত্যিকথা বলতে কি, অর্ধাহারে কাটিয়েছি। আমার ইংল্যান্ডের সম্মান বাঁচানোর জন্যে কম করে খাব ভেবেও তিন জনের সমান খেলাম আমি। কিন্তু আমার তাই ও লজ্জায় ফেলে দিল আমাকে। প্রাণপণ চেষ্টায় আমি যখন খাওয়া শেষ করলাম তখনও দেখি সে খেয়ে চলেছে। বিশাল একেক টুকরো মাছ, মাংস মুখে পুরছে আর চিবোচ্ছে। আমি যদি তিন জনের সমান খেয়ে থাকি ও খেলে কমপক্ষে সাতজনের সমান। অবশেষে খাওয়া শেষ হলো তার। লম্বা করে একটা নিশ্বাস ফেলে হাত ধোয়ার পানি চাইল সে।