আমাকে ছেড়ে দিয়ে লোকটা তার প্রশস্ত বুকের ওপর আঙুল ঠেকিয়ে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল আমি হিটিহিটি। তুমি মিডশিপম্যন! কি নাম?
আরও একবার বিস্মিত হওয়ার পালা আমার। ইংল্যান্ড থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে প্রায় অসভ্য এই ইন্ডিয়ানদের দেশে ইংরেজি কথা শুনব স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। কয়েক মুহূর্ত কোন কথা যোগাল না আমার মুখে। হিটিহিটি আবার করল প্রশ্নটা:
এক নাম?
বিয়্যাম, জবাব দিলাম আমি।
বিয়্যাম! বিয়্যাম। সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে উচ্চারণ করল হিটিহিটি। এদিকে জনতার মুখে মুখেও প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করেছে, বিয়্যাম! বিয়্যাম! বিয়্যাম!
দীর্ঘদিন ধরে যে জিনিসের জন্যে আমার প্রাণ আকুল হয়ে উঠেছে সে জিনিস চাইলাম এবার। বললাম, একটু খাওয়ার পানি দিতে পারো আমাকে?
হিটিহিটি চমকে উঠে আমার হাত ধরল। চিৎকার করে চারপাশের লোকদের দিকে তাকিয়ে কি একটা নির্দেশ দিল। অমনি ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে কয়েকজন ছুটল দ্বীপের ভেতর দিকে। হিটিহিটি আমার হাত ধরে সৈকতের ঠিক পেছনে একটা ভোলা একচালার কাছে নিয়ে গেল। কয়েকজন তরুণী দ্রুত একটা মাদুর পেতে দিল। বসলাম আমরা। পাশাপাশি। একটু পরেই, যারা ছুটে চলে গিয়েছিল তারা ফিরে এল। এক জনের হাতে বড়সড় একটা শুকনো লাউয়ের খোল। টলটলে পানি তাতে। আমার দিকে এগিয়ে দিল। এক নিশ্বাসে আমি খোলটার অর্ধেক খালি করে ফেললাম।
এর পর একজন একটা ভাব কেটে এনে দিল-প্রথমবারের মত আমি স্বাদ নিলাম দক্ষিণ সাগরীয় এলাকার এই শীতল, মিষ্টি মদের। বড় একটা পাতা বিছিয়ে দেয়া হলো পাশে। কয়েকজন তরুণী পাকা কলা এবং আরও কয়েক রকমের ফল এনে রাখল তার ওপর। হিটিহিটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, খাও!
লোভীর মত ফলগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাব, এমন সময় উল্লসিত একটা চিৎকার ভেসে এল সৈকতের দিক থেকে। ঘাড় ফেরাতেই দেখলাম বাউন্টির বড় নৌকাটা এগিয়ে আসছে ফেনাময় ঢেউয়ের মাথায় নাচতে নাচতে। ব্লাই বসে আছেন তার পেছন দিকে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল হিটিহিটি।
ও পারাই! সবিস্ময়ে চিৎকার করল সে। ব্লাই শব্দটা তার অনভ্যস্ত উচ্চারণযন্ত্রের হাতে পড়ে পারাই হয়ে গেছে দেখে বেশ মজা পেলাম আমি। একটু পরেই আবার সে বসল আমার পাশে। বলল, তুমি, আমি, তাইও, হ্যাঁ?
আমি কিছু বলার আগেই আবার সে উঠে দাঁড়াল। ছুটল সৈকতের দিকে। নৌকাটা পৌঁছে গেছে তীরে। আমিও উঠে এগোলাম তার পেছন পেছন।
সবার আগে হিটিহিটিই অভ্যর্থনা জানাল ব্লাইকে, যেন কত দিনের পরিচিত দুজন। ব্লাইয়ের মুখেও দেখলাম পরিচিতের হাসি।
হিটিহিটি, প্রৌঢ় তাহিতীয় লোকটার করমর্দন করতে করতে তিনি বললেন, একদম আগের মতই আছ। পাকা চুলগুলো না থাকলে বুঝতেই পারতাম না তোমার বয়েস বেড়েছে।
হাসল হিটিহিটি। দশ বছর, হ্যাঁ? অনেক সময়! তুমি মোটা হয়েছ, পারাই!
এবার হাসার পালা ক্যাপ্টেনের।
আসো, আসো, হিটিহিটি বলে চলল। অনেক শুয়োর খাও! ক্যাপ্টেন টুট (কুক) কই? শিগগির আসবে তাহিতিতে?
বাবার কথা জিজ্ঞেস করছ?
অবাক চোখে ব্লাইয়ের দিকে তাকাল হিটিহিটি। ক্যাপ্টেন টুট তোমার বাবা!?
হ্যাঁ-তুমি জানতে না?
কয়েক মুহূর্ত বিস্মিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল ইন্ডিয়ান গোত্রপতি। তারপর অদ্ভুত এক খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখ। হাত উঁচু করে জনতাকে চুপ করতে বলে উদাত্ত স্বরে ভাষণ দিতে লাগল সে। ব্লাই পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, এই ফাঁকে আমার কানে কানে বললেন:
সবাইকে বলে দিয়েছি, ক্যাপ্টেন কুকের মারা যাওয়ার খবরটা যেন ইন্ডিয়ানদের না জানায়। তুমিও খেয়াল রেখো, মুখ ফস্কে কখনও যেন বলে বোসো না কুক নই। আমি কুকের ছেলে কথাটা ওদের বিশ্বাস করাতে পারলে সহজে আমাদের কাজ উদ্ধার হবে।
ব্লাইয়ের কথা যে কতখানি সত্যি বুঝতে পারলাম একটু পরেই হিটিহিটির ভাষণ শেষ হতেই গুঞ্জন উঠল সমবেত তাহিতীয়দের ভেতর। উত্তেজিত ভঙ্গিত কথা বলছে সবাই। অদ্ভুত কৌতূহল এবং বিস্ময়ের সঙ্গে তাকাচ্ছে:ব্লাইয়ের দিকে। বুঝলাম ওদের চোখে ক্যাপ্টেন কুকের ছেলে মানে ছোটখাট দেবতা বিশেষ। ক্যাপ্টেন কুক নিজে তাহলে কি ছিলেন সহজেই অনুমান করতে পারলাম।
এখানে সুযোগ পেয়ে আমি মিস্টার ব্লাইকে জানালাম, হিটিহিটি আমার তাইও হতে চেয়েছে।
চমৎকার! মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন ব্লাই। ও এখানকার বড়সড় একজন গোত্রপতি। ওকে তাইও হিসেবে পেলে অনেক সহজ হয়ে যাবে তোমার কাজ। ইন্ডিয়ান লোকটার দিকে ফিরে ডাকলেন তিনি, হিটিহিটি!
হ্যাঁ, পারাই।
মিস্টার বিয়্যাম বলল, তুমি আর ও নাকি বন্ধু হয়েছ?
মাথা ঝাঁকাল হিটিহিটি। আমি, বিয়্যাম তাইও!
বেশ বেশ! বললেন ব্লাই। মিস্টার বিয়্যাম আমাদের দেশের এক গোত্রপতির ছেলে। তোমাদের জন্যে নানা রকম উপহার নিয়ে এসেছে ও; বিনিময়ে, আমি চাই, তোমার বাড়িতে রাখবে ওকে। যে কদিন আমরা এখানে আছি ও তোমাদের ভাষা শিখবে, লিখে নেবে। তাহলে ভবিষ্যতে যে সব বৃটিশ নাবিক এখানে আসবে তারা তোমাদের সাথে তোমাদের ভাষায়ই কথা বলতে পারবে। বুঝেছ আমার কথা?
কোন জবাব না দিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়াল হিটিহিটি। বিশাল একটা থাবা বাড়িয়ে ধরে মৃদু হেসে বলল, তাইও, হ্যাঁ?
আমরা হাত মেলালাম।