অবশেষে উপকূলের কয়েকশো গজের মধ্যে পৌঁছুল বাউন্টি। আর এগোনো নিরাপদ নয় মনে করে পাল গুটিয়ে নোঙ্গর ফেলার নির্দেশ দিলেন ক্যাপ্টেন। এবার, মিছরির ওপর পিঁপড়ে যেমন হামলে পড়ে আমাদের জাহাজটাকে তেমনি করে হেঁকে ধরল তাহিতীয়রা। শত শত ক্যানো ঘিরে। ধরল চারদিক থেকে। প্রত্যেকটার আরোহীরা অন্যগুলোকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে, কাছাকাছি হতে চাইছে আমাদের। ডেকের ওপর একদল মেয়ের সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করছি আমি, এই সময় আমার ডাক পড়ল ক্যাপ্টেনের কেবিনে।
ঢুকে দেখি কেবিনে একাই আছেন মিস্টার ব্লাই। টেবিলের ওপর বিছানো মাতাতাই উপসাগরের একটা মানচিত্রের ওপর ঝুঁকে আছেন তিনি। আমার পায়ের শব্দ পেয়ে সোজা হয়ে একটা সিন্দুক দেখিয়ে বসতে ইশারা করলেন।
তোমাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই, মিস্টার বিয়্যাম, শুরু করলেন তিনি। এই মাতাভাই উপসাগরে বেশ কয়েক মাস থাকতে হবে আমাদের যত দিন না মিস্টার বিলসন রুটিফলের চারা সংগ্রহের কাজ শেষ করছেন অন্তত তত দিন। আমি জাহাজের আর সব কাজ থেকে তোমাকে ছুটি দিচ্ছি। এখন থেকে, যতদিন আমরা এখানে আছি, আমার বন্ধু স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস-এর ইচ্ছানুযায়ী তুমি কাজ করবে। স্যার জোসেফের ইচ্ছা কি তা নিশ্চয়ই তোমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে আসবার আগে?
জি, স্যার।
তাহলে আর কি?-তীরে চলে যাও। যোগ্য একজন তাইও খুঁজে বের করো। তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই, সময় নিয়ে ভাল একজন তাহিতীয়কে বেছে নাও। একদিন, দুদিন, প্রয়োজন হলে এক সপ্তা সময় নাও। একজন ভাল–তাইও বেছে নেয়ার ওপরই নির্ভর করছে তোমার কাজের সাফল্য।
বুঝতে পেরেছি, স্যার।
বেশ তাহলে যাও। সপ্তায় সপ্তায় এলে আমাকে জানিয়ে যাবে তোমার কাজ কেমন এগোচ্ছে।
ডেকে উঠে আসতেই মুখোমুখি হয়ে গেলাম মিস্টার ফ্রায়ারের।
ক্যাপ্টেনের সাথে দেখা করে এলে? জিজ্ঞেস করল সে।
হ্যাঁ।
কাল রাতে আমাকে ডেকে নিয়ে উনি বলেছেন, যতদিন এখানে থাকব জাহাজের কোন কাজে যেন তোমাকে না লাগাই। কেন?–তীরে যাবে?
হ্যাঁ।
ইন্ডিয়ান ভাষার অভিধান তৈরি করবে, তাই না?
হ্যাঁ, আমাকে আসলে সেজন্যেই সঙ্গে এনেছেন মিস্টার ব্লাই।
বেশ বেশ। একটা কথা, দ্বীপবাসীদের সাথে কোন রকম বিনিময় বা ব্যবসা করতে যেও না, সব ধরনের ব্যবসার দায়িত্ব মিস্টার পেকওভারকে দেয়া হয়েছে। ইচ্ছে হলে উপহার দিতে পারো, বিনিময়ে কিছু নেবে না।
মনে থাকবে, স্যার।
ইন্ডিয়ানদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যখন খুশি তুমি তীরে যেতে পারো।
ধন্যবাদ, স্যার, বলে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি একটা জোড়া ক্যানো চলে যাচ্ছে জাহাজের কাছ থেকে। কিছুক্ষণ আগে ডাঙার কোন এক গোত্রপ্রধানের কাছ থেকে উপহার হিসেবে কয়েকটা শুকর নিয়ে এসেছিল ওটা। এখন ফিরে; যাচ্ছে। তীরে যাওয়ার জন্যে ভেতরে ভেতরে উদগ্রীব হয়ে উঠেছি আমি। মাস্টারকে জিজ্ঞেস করলাম, ওদের সঙ্গে যেতে পারি না?
নিশ্চয়ই। ডাকো না চিৎকার করে।
রেলিংয়ের কাছে ছুটে গিয়ে চিৎকার করে দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম জোড়া ক্যানোর আরোহীদের। ইশারায় জানালাম আমি ওদের সাথে তীরে যেতে চাই। মনে হলো আমার ইশারা বুঝতে পারল ওরা। ক্যানোর পেছন দিকে বসা দলনেতা গোছের এক লোক কি একটা নির্দেশ দিল দাড়ীদের। অমনি ক্যানোর, মুখ ঘুরে গেল আমাদের দিকে। কয়েক মিনিটের ভেতর, আবার বাউন্টির গায়ে এসে ভিড়ল ওটা। রেলিং টপকে আমি নেমে গেলাম। একটু পরেই আবার তীরের দিকে চলতে লাগল ক্যানোটা।
ডাঙায় পা রাখা মাত্র দলে দলে নারী পুরুষ ঘিরে ফেলল আমাকে। সংখ্যায় তারা এত বেশি, আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ভয় ভাঙতে বেশিক্ষণ লাগল মা অবশ্য। মানুষগুলো খুবই অদ্র, রীতিমত সুসভ্য বলা যায়। ওদের চোখে মুখে অপার বিস্ময় আর আমাকে স্বাগত জানানোর আকুতি ছাড়া অন্য কোন অনুভব নেই। বাচ্চারা মায়েদের স্কার্টের প্রান্ত আঁকড়ে ধরে আছে, ওরাও অবাক বিস্ময়ে দেখছে আমাকে। আর ওদের মা বাবারা ঠেলাঠেলি করে এগিয়ে আসতে চাইছে আমার সাথে করমর্দন করার জন্যে। হ্যাঁ, পরে জেনেছিলাম, প্রিয় বা শ্রদ্ধেয় কাউকে স্বাগত জানানোর জন্যে করমর্দনের রেওয়াজ চালু আছে–তাহিতীয়দের ভেতর।
হঠাৎ গম্ভীর একটা গলা ভেসে এল ওপাশ থেকে। জনতা দুপাশে সরে মাঝ বয়েসী দীর্ঘদেহী এক লোককে এগিয়ে আসার পথ করে দিল। সেই সাথে মৃদু একটা গুঞ্জন শোনা গেল:
ও হিটিহিটি!
মসূণ-কামানো গাল লোকটার, বেশির ভাগ ইন্ডিয়ান পুরুদের ভেতর যেটা দেখা যায় না। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, জায়গায় জায়গায় ধূসরের ছোপ লেগেছে। অদ্ভুত সুন্দর কারুকাজ করা আলখাল্লা তার পরনে। লম্বায় ছফুটের ওপরে। দারুণ স্বাস্থ্য। সাধারণ তাহিতীয়দের চেয়ে ফর্সা গায়ের রঙ। মুখে সরল, প্রাণখোলা-একটু যেন কৌতুকপূর্ণ অভিব্যক্তি। প্রথম দর্শনেই বুঝতে পারলাম এ লোক সাধারণ কেউ নয়। নিশ্চয়ই কোন গোত্রপতি বা গোত্রপতির পরিবারের সদস্য।
এগিয়ে এল সে। দুহাতে আমার দুকাঁধ ধরে আমার গালে নাক ঠেকিয়ে লম্বা করে শ্বাস টানল কয়েকবার। ব্যাপারটার আকস্মিকতায় প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও একটু পরেই বুঝতে পারলাম, এ এক ধরনের অভিবাদন জানানোর রীতি। ক্যাপ্টেন কুক যার নাম দিয়েছিলেন নাক-ঘষা।