.
বিকেল নাগাদ দ্বীপটায় কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম আমরা।
তাহিতির সবচেয়ে সুন্দর সবচেয়ে ঐশ্বর্যময় অংশ তাইয়ারাপু। তার পাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছে বাউন্টি। আমি দাঁড়িয়ে আছি রেলিংয়ের ওপর ভর দিয়ে। কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছি না দ্বীপটার দিক থেকে। উপকূলের প্রায় মাইল খানেক এপাশে দীর্ঘ এক প্রবাল প্রাচীর দ্বীপটাকে বেষ্টন করে আছে। সাগরের ঢেউ তাতে বাধা পেয়ে ভেঙে পড়ছে শতধা হয়ে। প্রাচীরের ওপাশে শান্ত লেগুন। সেখানে ক্যানোয় চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছে স্থানীয় ইন্ডিয়ানরা। লেগুনের ওপাশে দীর্ঘ বালুকাবেলা। তার ওপাশে সরু একফালি জমি। তাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছবির মত তৃণ ছাওয়া কুটির; আভা, রুটিফল; নারকেলের বাগান। আরও ওপাশে ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে গেছে সবুজ পাহাড়ের ঢাল। একেবারে চূড়া পর্যন্ত গাছপালায় ছাওয়া বিশাল পাহাড়। সবুজের ফাঁকে ফাঁকে দেখতে পাচ্ছি অসংখ্য রুপালি রেখা। ঝরনা ওগুলো। জলপ্রপাতের মত নেমে এসেছে পাহাড়ের বুক ফুড়ে। সত্যিই অদ্ভুত। আমার ইউরোপীয় চোখ বিশ্বাসই করতে চাইছে না, এসব বাস্তব। মনে হচ্ছে, সুন্দর কোন স্বপ্ন দেখছি যেন।
সারাটা বিকেল আমরা প্রবাল প্রাচীরের পাশে পাশে জাহাজ চালিয়ে গেলাম। তাইয়ারাপু এলাকার পর ফাওন, তারপর হিতিআঃ অবশেষে সন্ধ্যা যখন, হয় হয় তখন পৌঁছলাম তাইয়ারেই-এর পাহাড়ী উপকূলে। এখানে হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল প্রবাল প্রাচীর। সাগর ভয়ঙ্কর গর্জনে গিয়ে ভেঙে পড়ছে পাহাড়ের পাদদেশে।
বিশাল উপত্যকা প্যাপেনুর সামনাসামনি এসে পাল গোটানোর নির্দেশ দিলেন ব্লাই। সন্ধ্যা হতে বেশি বাকি নেই। আজ আর এগোনো যাবে না। বাতাস পড়ে গেছে। লেগুনের ভেতর জল যেমন স্থির তেমন স্থির প্রকৃতি। বাতাসের প্রবাহ নেই বললেই চলে। নোঙ্গর ফেলল না বাউন্টি। এমনিই ভেসে রইল শান্ত সাগরে।
রাতে খুব একটা ঘুমাতে পারল না নাবিকরা। বহুদিন পর কাল আবার ডাঙার মাটিতে পা রাখতে পারবে ভেবে উত্তেজিত সবাই। যারা স্কার্ভিতে আক্রান্ত তারা ভাবছে ডাঙায় নেমে খেতে পারবে তাজা ফল-মূল, শাক-সজি; শিগগিরই আবার সুস্থ সতেজ হয়ে উঠবে তারা।
পরদিন ভোরে, দিনের প্রথম আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম সবাই। রাতের বেলা বেশ খানিকটা পশ্চিমে সরে এসেছে বাউন্টি। এখন আমাদের সোজাসুজি সাগরের পাশে শুয়ে আছে ভাইপুপু উপত্যকা। সেখান থেকে ছোট্ট একটা নদী নেমে এসেছে। নদীটা যেখানে সাগরে মিশেছে সে জায়গার নাম পয়েন্ট ভেনাস। এই পয়েন্টে ক্যাপ্টেন কুক তাঁর অস্থায়ী মানমন্দির স্থাপন করেছিলেন শুক্র গ্রহ পর্যবেক্ষণের জন্যে। সে কারণেই জায়গাটার নাম দিয়েছিলেন তিনি পয়েন্ট ভেনাস (শুক্র গ্রহ)। দ্বীপের আরও ভেতর দিকে ভাইপুপু উপত্যকার প্রান্ত থেকে উঁচু হয়ে উঠে গেছে সেই বিশাল পাহাড়টার চূড়া, স্থানীয়রা যার নাম দিয়েছে ওয়োহেনা। অন্তত সাত হাজার ফুট হবে ওটার উচ্চতা। সূর্যের প্রথম আলোয় কমলা,দেখাচ্ছে পাহাড়টা।
ছোট ছোট দুটো পাল মেলে দিলাম আমরা। ধীর গতিতে এগিয়ে চলল বাউন্টি এক লিগ মত দূরে উপকূলের দিকে। একটু পরে লক্ষ করলাম সৈকতের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে হাজার হাজার দ্বীপবাসী। অসংখ্য ক্যানো জলে ভাসানোর আয়োজন করছে তারা। আমরা আধ লিগ এগোনোর আগেই দেখলাম ক্যানোয় ক্যানোয় গিজ গিজ করছে মাতাই উপসাগর। প্রতিটা ক্যানোরই লক্ষ্য আমাদের জাহাজু। দ্রুত এগিয়ে আসছে সগুলো।
দেখতে দেখতে একেবারে সামনের ক্যানোগুলো পৌঁছে গেল বাউন্টির কাছে। ইন্ডিয়ানদের চিৎকার শুনতে পেলাম:
তাইও? পিরিতেন? রিমা? অর্থাৎ বন্ধু? ব্রিটেন? লিমা শেষ প্রশ্নটা ওরা করল বাউন্টি পেরুর লিমা থেকে আসা কোনো স্প্যানিশ জাহাজ কিনা জানাবার জন্যে।
তাইও! জবাব দিলেন ব্লাই। তাইও! পিরিতেন!
কথাটা শেষও করতে পারেননি ব্লাই, একটা ক্যানো ভিড়েছিল বাউন্টির গায়ে-সেটার আরোহীরা রেলিং টপকে এসে নামল ডেকের ওপর।
দেখতে দেখতে তাহিতীয় মানুষে ভরে গেল বাউন্টির ডেক। বেশির ভাগই পুরুষ-দীর্ঘদেহী, সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান সবাই। গায়ের রঙ সামান্য তামাটে। রঙচঙে ছবি আঁকা এক টুকরো কাপড় জড়ানো তাদের কোমরের কাছে, ঊর্ধ্বাঙ্গে কারও কারও কাপড় আছে, কারও নেই। মাথায় নারকেল পাতায় তৈরি মুকুটের মত এক ধরনের জিনিস। স্থানীয়রা একে বলে টাউমাতা। যে দুচারজন মহিলা এখন এসেছে তাদের সবাই সমাজের নিচু স্তরের মানুষ। তাদের পরনে হাঁটুর নিচে পর্যন্ত ঝুলে পড়া সাদা কাপড়ের কুঁচিওয়ালা, স্কার্ট, ঊর্ধ্বাঙ্গে অদ্ভুত দেখতে একটু আঁটো ধরনের আঙরাখা, এমন ভাবে তৈরি যাতে ডান হাতটা মুক্ত থাকে, অনেকটা রোমানদের টোগার মত।
মিস্টার ব্লাই কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, দ্বীপবাসীদের সাথে কোন অবস্থাতেই যেন আমরা কোন রকম দুর্ব্যবহার না করি। খালি দৃষ্টি রাখতে হবে কোন জিনিস ওরা যেন চুরি বা নষ্ট করার সুযোগ না পায়। সুতরাং ওদের সঙ্গে সাধ্যমত ভাল ব্যবহার করতে লাগলাম আমরা। আমি আমার সিন্দুক থেকে কিছু টুকটাক উপহার এনে দিলাম কয়েকজনকে ভীষণ খুশি হলো তারা। এমনিতেই হাসিখুশি মানুষগুলো, উপহার পেয়ে এ কান থেকে ও কান পর্যন্ত বিস্তৃত হলো তাদের হাসি।