জিনিসগুলো সব বের করে ঝেড়ে ঝড়ে আবার ওঠাতে শুরু করেছি এমন সময় শুনতে পেলাম ব্লাইয়ের রুক্ষ, কর্কশ কণ্ঠস্বর। যেখানে আমি বসে আছি সেখান থেকে খুব বেশি হলে পনেরো ফুট দূরে ব্লাইয়ের কেবিন।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছ কেন, মিস্টার ফ্রায়ার? চিৎকার করলেন ক্যাপ্টেন। ভেতরে ঢোকো।
মাস্টারের গলা শুনতে পেলাম; জি, স্যার।
কাল অথবা পরশু, ব্লাই বললেন, মাতাভাই উপসাগরে নোঙ্গর করব আমরা। এ পর্যন্ত খাবার এবং অন্যান্য জিনিস যা খরচ হয়েছে তার একটা তালিকা তৈরি করিয়েছি স্যামুয়েলকে দিয়ে। এই যে দেখ-এতে একটা সই লাগবে তোমার।
দীর্ঘ নীরবতা এরপর। অবশেষে আবার শুনতে পেলাম ফ্রায়ারের গলা:
না, স্যার, এতে আমি সই করতে পারব না।
সই করতে পারবে না! কি বলতে চাইছ তুমি?
স্যামুয়েল ভুল করেছে। এত মাংস কখনোই দেয়া হয়নি নাবিকদের।
ভুল করছ তুমি, ফ্রায়ার, আমি জানি কোন জিনিস কতটুকু তোলা হয়েছিল। স্যামুয়েল ঠিকই লিখেছে।
আমি সই করতে পারব না, স্যার।
কেন? স্যামুয়েল যা করেছে আমার হুকুমে করেছে।…এক্ষুণি সই করবে! না হলে
আমি সই করতে পারব না, আবার বলল মাস্টার, অন্তত স্বেচ্ছায় নয়।
করবে: কার করে উঠলেন ব্লাই! করে আরও ভাল করবে! ধুপ ধাপ পায়ের আওয়াজ শুনলাম, সম্ভবত দরজার কাছে গেলেন ব্লাই। তারপর আবার চিৎকার; মিস্টার ক্রিশ্চিয়ান! সবাইকে ডেকে ডাকো এক্ষুণি!
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ক্রিশ্চিয়ানের চিৎকার শুনতে পেলাম। জাহাজের সামনে পৌঁছে দেয়া হলো ক্যাপ্টেনের আদেশ। কিছুক্ষণের ভেতর সবাই জড়ো হলো ডেকে। ঝপ পট আর জিনিসগুলো সিন্দুকে ভরে আমিও গিয়ে দাঁড়ালাম। স্লাই এলেন। যুদ্ধকালীন আচরণবিধির বিদ্রোহ বা বিদ্রোহাত্মক আচরণের শাস্তি সম্পর্কিত ধারাটি পড়ে শোনালেন। এরপর এগিয়ে এল স্যামুয়েল। হাতে সেই তালিকা লেখা খাতা, কলম কার কালির দোয়াত!
এবার, মিস্টার ফ্রায়ার, ব্লাই বললেন, সই করো এই খাতায়।
মৃত্যুর মত নিস্তব্ধ বাউন্টির ডেক। ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ফ্রায়ায়। তারপর এগিয়ে গিয়ে কলমটা নিল স্যামুয়েলের কাছ থেকে।
মিস্টার ব্লাই, অতি কষ্টে ক্রোধ সংবরণ করে সে বলল, জাহাজের সবাই সাক্ষী থাকল, আপনার নির্দেশ পালন করার জন্যেই কেবল আমি সই করছি। কিন্তু, স্যার, ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে গেল ভাবলে ভুল করবেন আপনি।
ঠিক সেই সময় মাস্তুলের মাথা থেকে ভেসে এল একটা চিৎকার:
ডাঙা দেখা যায়!
.
চার
ছোট্ট পাহাড়ী দ্বীপটার নাম মেহেতিয়া। অবস্থান তাহিতির চল্লিশ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে। দুচোখ ভর্তি বিশ্বাস নিয়ে আমি তাকিয়ে রইলাম দিগন্তরেখার কাছে বিন্দুর মত স্থির অবয়বটির দিকে। সত্যিই তাহলে দক্ষিণ সাগরীয় দ্বীপ মালায় এসে গেলাম আমরা। সন্দেহ নেই; বাউন্টি এখন সেদিকেই এগোচ্ছে।
সারারাত ঘুমাতে পারলাম না উত্তেজনায়। দ্বীপটাকে কাছ থেকে দেখতে কেমন লাগবে কল্পনা করতে লাগলাম কেবল।
পরদিন ভোরে, ঠিক সূর্যোদয়ের আগে উপকূলের খুব কাছ দিয়ে মতিয়া দ্বীপকে পেরিয়ে গেল বাউন্টি। জীবনে প্রথমবারের মত দেখলাম নারকেল গাছের সবুজ ঝাঁকড়া টুপি পরা দীঘল শরীর, ঝোঁপ ঝাড়ের ভেতর দক্ষিণ সাগরীয় দ্বীপবাসীদের তৃণ ছাওয়া ছোট্ট কুটির। দেখলাম ঝকঝকে রূপালি সৈকতে হেঁটে বেড়াচ্ছে ওদের কয়েকজন। বাউন্টিকে দেখা মাত্র ছুটে দ্বীপের ভেতর দিকে চলে গেল তারা। একটু পরেই দলে দলে নারী পুরুষ শিশু এসে ভীড় করল সাগরতীরে। চিৎকার, সেইসাথে বড় বড় সাদা কাপড় নেড়ে ওরা আমাদের আমন্ত্রণ জানাতে লাগল দ্বীপে।
জাহাজ থামিয়ে নৌকা নামানোর নির্দেশ দিলেন ব্লাই। কিন্তু খেয়াল করলাম, মাথায় ফেনার মুকুট পরে বিশাল বিশাল ঢেউ এগিয়ে যাচ্ছে সৈকতের দিকে। এই ঢেউ এড়িয়ে নৌকা তীরে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও
মেহেতিয়ায় নামতে পারলাম না আমরা। হাত নেড়ে বিদায় জানালাম, দ্বীপবাসীদের। ভরা পালে এগিয়ে চলল বাউন্টি।
সবে মাত্র দ্বীপটার উত্তর প্রান্ত পার হয়েছি আমরা, এই সময় মাস্তুলের ওপর থেকে স্মিথ চিৎকার করে উঠল:
দেখুন, মিস্টার বিয়্যাম!
ওপর দিকে তাকালাম, হাত তুলে সামনের দিকে ইশারা করে আছে স্মিথ। ওর ইশারা অনুসরণ করে চোখ ফেরাতেই দেখি, অনেক অনেক লিগ দূরে বিশাল এক পাহাড়ের অবয়ব উঠে এসেছে সাগর ফুড়ে। সকালের আলোয় হালকা নীল, একটু যেন ভৌতিক দেখাচ্ছে। চূড়া থেকে সমান ভাবে ঢালু হয়ে নেমে এসেছে পাহাড়টার দুই পাশ।
তরতরিয়ে এগোচ্ছে আমাদের জাহাজ। আমি তাকিয়ে আছি। ঘোর লেগেছে যেন চোখে। কতক্ষণ অমন সম্মোহিতের মত দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না, সংবিৎ ফিরতেই ছুটে গেলাম ডেকে। মিস্টার ব্লাইও তাকিয়ে আছেন অবয়বটার দিকে। অদ্ভুত প্রসন্ন দৃষ্টি চোখে। মেজাজটাও সেরকম। আমার পিঠ চাপড়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন তিনি।
ওই যে দেখ, আঙুল তুলে ইশারা করলেন ব্লাই ভৌতিক অবয়বটার দিকে, ওটাই তাহিতি! অবশেষে আসতে পেরেছি আমরা, কি বলো?
মনে হচ্ছে খুব সুন্দর দ্বীপটা, আমি মন্তব্য করলাম।
সত্যিই সুন্দর-এত সুন্দর আর হয় না। ক্যাপ্টেন কুক ইংল্যান্ডের পর যদি কোন দেশকে ভালবেসে থাকেন তো সে এই তাহিতি। আমিও, বুড়ো বয়েসে যখন হাতে কোন কাজ থাকবে না, জীবনের শেষ দিনগুলো এখানকার নারকেল কুঞ্জের ছায়ায় কাটাতে পারলে আর কিছু চাইব না। এই দেশের মত এর মানুষগুলোও সুন্দর। লম্বা পথ পাড়ি দিতে হলো ওদের কাছে আসতে। কাল রাতে লগ দেখে হিসেব করছিলাম। এ পর্যন্ত কত মাইল জাহাজ চালিয়েছি আমরা জানো? সাতাশ হাজার মাইলেরও বেশি!