ইয়ং-এর নেতৃত্বে দুজন খালাসী আর বাউন্টির নাবিক ডিক স্কিনারকে আমাদের ছোট কাটারটা দিয়ে পাঠানো হয়েছিল শেলফিশ আর কাঁকড়া সগ্রহ করে আনার জন্যে।
নৌকা ভাসিয়ে ফ্রেডারিক হেনরি অন্তরীপের দিকে চলে যায় ওরা। বিকেলের ভেতর ফিরে আসার কথা কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার পরও ওরা ফিরল না। দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠল জাহাজের সবাই। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হলো। অবশেষে এল ওরা। কিন্তু চারজন নয়-তিনজন। নাপিত স্কিনার নেই নৌকায়। কোথায় সে, জিজ্ঞেস করতে ইয়ং যা জানাল তার মর্মার্থ-হাঁটতে হাঁটতে বনে ঢুকেছিল কিনার, তারপর আর ফিরে আসেনি।
কাণ্ডের ভেতরটা ফাঁপা একটা গাছ দেখতে পায় ও, মিস্টার ব্লাইকে বলল ইয়ং। আশপাশে মৌমাছি উড়তে দেখে ওর ধারণা হয় গাছটার ভেতর চাক আছে। মধু পাওয়া যেতে পারে ভেবৈ ও আগুন জ্বেলে মৌমাছিগুলোকে গাছের ভেতর থেকে বের করে আনার অনুমতি চাইল আমার কাছে। বলল, কি করে মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করতে হয় ও জানে, ছেলে বেলায় নাকি অনেকবার করেছে এ কাজ। মধু পেলে আপনি খুশি হবেন ভেবে আমি অনুমতি দেই। ওকে রেখে আমরা তিনজন চলে গেলাম শেলফিশ যোগাড় করতে। ঘণ্টা দুয়েক পর ফিরে দেখি গাছটার গোড়ায় আগুন জ্বলছে, কিন্তু স্কিনার নেই। ওর নাম ধরে ডাকাডাকি করলাম, সাড়া না পেয়ে শেষে কাটার থেকে নেমে বনের ভেতর ঢুকলাম। তিনজন সমানে চিৎকার করতে করতে খুঁজলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত, কিন্তু, স্যার, ওর কোন চিহ্নই দেখতে পেলাম না।
আমি জানতাম সেদিন বিকেলে নাপিতের কাছে দাড়ি কামানোর কথা ব্লাইয়ের। সময় মত কাজটা হয়নি বলে এমনিতেই বিরক্ত হয়ে ছিলেন তিনি। এখন যে-ই শুনলেন নাপিত ব্যাটা উধাও হয়ে গেছে, জ্বলে উঠলেন তেলে বেগুনে।
জাহান্নামে যা শয়তানের বাচ্চা, গর্জে উঠলেন ক্যাপ্টেন। তোর মত যত মিডশিপম্যান আছে সেগুলোও আস্ত একেকটা শয়তান! মধু পেলে ওই জায়গায় বসেই তোরা খেয়ে আসতি, আমি তা ভাল করেই জানি! স্কিনার কোথায় বল? জানিস না? তাহলে যা, এক্ষুণি যা, জেনে আয়! তোর সঙ্গে যে দুটো বদমাশ ছিল ওদেরও নিয়ে যা। ফিনারকে ছাড়া ফিরবি না জাহাজে!
পূর্ণবয়স্ক মানুষ ইয়ং। ক্যাপ্টেনের কথা শুনে লাল হয়ে উঠল ওর চোখ মুখ। তক্ষুণি সে দুই খালাসীকে ডেকে নিয়ে রওনা হয়ে গেল। ফিরল পরদিন দুপুরের সামান্য আগে। এবার স্কিনার আছে ওদের সঙ্গে। জানা গেল আরও মৌচাক যদি পাওয়া যায় এই আশায় ও বনের ভেতর ঢুকে পথ হারিয়ে ফেলেছিল।
চব্বিশ ঘণ্টার ওপর না খেয়ে আছে চারটে মানুষ, কথাটা যেন মনেই পড়ল না ব্লাই-এর। ইয়ং ডেকে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তিনি চিৎকার করে উঠলেন:
এসো, মিস্টার ইয়ং, কিভাবে কর্তব্য পালন করতে হয় সে সম্পর্কে সামান্য শিক্ষা তোমাকে দেব। মরিসন!
জি, স্যার!
তুমিও এসো, পেছনের ওই কামানটার সাথে বাঁধো মিস্টার ইয়ংকে। বারো ঘা লাগাবে। আর এই বদমাশ নাপিতটাকে বাঁধো গ্যাংওয়ের সাথে। ওকে লাগাবে চব্বিশ ঘা।
ইয়ং এবং ফিনারকে চাবকানোর খুঁটিনাটি বর্ণনা আমি দেব না, শুধু এটুকু বলব, সেই বারো ঘা চাবুক খাওয়ার পর আমূল বদলে গেল ইয়ং। ওর ভেতর থৈকে কে যেন উপড়ে নিয়েছে প্রাণ নামক জিনিসটা। মুখ বুজে কাজ করে যায়, নেহায়েত প্রয়োজন না পড়লে কারও সাথে কথা বলে না, এমন কি বার্থের অন্য মিডশিপম্যানদের সাথেও না। বহুদিন পর, সমস্ত কিছু যখন ওলট পালট হয়ে গিয়েছিল, ও আমাকে বলেছিল, বাউন্টি ইংল্যান্ডে পৌঁছুলেই সে চাকরি ছেড়ে দেবে বলে ঠিক করেছিল।
জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন?
ইয়ং জবাব দিয়েছিল, প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে। ওর অধীনে চাকরি করে ওর কিছু করা যেত না, তাই চেয়েছিলাম সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে ওর মুখোমুখি হব।
*
সেপ্টেম্বরের চার তারিখে আবার আমরা নোঙ্গর তুললাম। অ্যাডভেঞ্চার পেছনে ফেলে এগিয়ে চললাম ওতাহিতের (এখনকার তাহিতি) দিকে। সাত সপ্তাহ পর দেখলাম আমার জীবনের প্রথম দক্ষিণ সাগরীয় দ্বীপ। আমাদের অবস্থা তখন শোচনীয়। ক্যাপ্টেনের দুর্ব্যবহার আর অর্ধাহার অনাহারে পাগল হওয়ার দশা সবার। তার ওপর নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে স্কার্ভি। বাউন্টির অর্ধেকের বেশি নাবিক আক্রান্ত হয়েছে এই রোগে।
সেদিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। বিকেল বেলায় কোন কাজ নেই। তাহিতি আর বেশি দূরে নয় ভেবে বসলাম স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস-এর পরামর্শে স্থানীয়দের সাথে বিনিময় করার জন্যে যে সব জিনিস এনেছি সেগুলো ভাল করে একবার দেখার জন্যে। স্যার ব্যাঙ্কস বলেছিলেন পেরেক, রেতি, মাছ ধরা বড়শি ইত্যাদির প্রচুর চাহিদা তাহিতীয়দের ভেতর। সস্তা গহনা পত্রেরও চাহিদা আছে-বিশেষ করে মেয়েদের ভেতর। মায়ের কাছ থেকে পঞ্চাশ পাউন্ড নিয়েছিলাম এসব কেনার জন্যে। স্যার ব্যাঙ্কস দিয়েছিলেন আরও পঞ্চাশ পাউন্ড। পুরো টাকারই জিনিসপত্র কিনেছিলাম আমি। আমার জাহাজী সিন্দুকটার অর্ধেক ভরে আছে নানা আকারের বড়শি, পিতলের তারের কুণ্ডলী; সস্তা আংটি, কানের দুল, চুড়ি, হার; রেতি, কাঁচি, ক্ষুর, ছোট ছোট আয়না ইত্যাদিতে। রাজা জর্জের ছবিও এনেছি এক ডজন, স্যার জোসেফ এগুলো যোগাড় করে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া আছে-সিন্দুকের একেবারে নিচে এক কোনায় লুকিয়ে রেখেছি-একটা বাক্স। মখমলে মোড়া। একজোড়া বালা আর একটা হার রয়েছে ওতে। অন্যসব জিনিসের মত সস্তা নয় এগুলো, খুব বেশি, দামীও অবশ্য নয়। বেশ রোমান্টিক স্বভাবের ছেলে ছিলাম আমি তখন। মনে হয়েছিল কোন সুন্দরী তাহিতীয় যদি আমাকে ভালবাসে বিনিময়ে আমি কি দেব?-তাই নিয়েছিলাম বালা আর হারটা। আজ এত বছর পরে হাসি পায় আমার। ভাবি, কি সরল সোজা ছিলাম তখন।