আমার ওপর পানি সংগ্রহকারী দলের দায়িত্ব দিয়েছেন ব্লাই। সৈকতের পশ্চিম প্রান্তে একটা ঝর্না আছে। সেখান থেকে পানির পাত্রগুলো ভরে আমাদের বড় কাটার-এ (এক মাস্তুলওয়ালা দ্রুতগামী নৌকা) করে জাহাজে নিয়ে তুলতে হবে। দিনে দুতিনবার আমরা যাওয়া আসা করতে লাগলাম বাউন্টি আর ঝর্নাটার ভেতর।
ছুতোর মিস্ত্রী পার্সেলের ওপর দায়িত্ব কাঠ সগ্রহের। তাকে সাহায্য করছে দুই সহকারী ছুতোর নরম্যান আর ম্যাকইন্টশ আর দুজন খালাসী। ব্লাই নিজে বনের ভেতর ঘুরে দেখিয়ে দিয়েছেন কোন কোন গাছ কাটতে হবে। প্রথম দুতিন দিনে পার্সেলের সহকারীরা দুতিনটে বড় বড় ইউক্যালিপটাস গাছ কাটল। আগার দিকের ডাল পালা হেঁটে চেরাই শুরু করার আগে কি মনে করে গাছগুলো ভাল মত একবার পরীক্ষা করল পার্সেল। এবং বুঝতে পারল বৃথা গেছে তিন দিনের পরিশ্রম। এ-গাছ দিয়ে ভাল তা হবে না। তখন সে অন্য এক জাতের কতকগুলো ছোট ছোট গাছ কাটার নির্দেশ দিল। এই গাছগুলোর বাকল একটু রুক্ষ ধরনের, তবে কাঠ খুব শক্ত, লালচে রঙের।
সেদিন সকালে আমি আমার লোকদের পানি ভরা তদারক করছি। একটু দূরে পার্সেলের তত্ত্বাবধানে গাছ কাটছে তার লোকেরা। হঠাৎই ব্লাই উপস্থিত হলেন সেখানে। কাঁধে বন্দুক, সঙ্গে উদ্ভিদবিজ্ঞানী মিস্টার নেলসন। ভুরু কুঁচকে একবার গাছগুলোর দিকে তাকালেন ব্লাই। তারপরই কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার:
মিস্টার পার্সেল।
জি, স্যার?
এসব কি গাছ কাটছ? গর্জে উঠলেন ক্যাপ্টেন। এ দিয়ে যে তক্তা হবে তা আমাদের কী কাজে আসবে শুনি? আমার মনে হয় কোন ধরনের গাছ কাটতে হবে, তোমাকে আমি দেখিয়ে দিয়েছিলাম!
খুবই ভাল মিস্ত্রী পার্সেল। নিজের কাজ সে বোঝে; ব্লাই জাহাজ চালানোর কৌশল যতখানি বোঝেন ততখানিই বোঝে। এ নিয়ে তার একটু অহঙ্কারও আছে। তাছাড়া সার্জন ও ব্যাকাসকে বাদ দিলে বাউন্টির সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ সে [ মেজাজটাও তার ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের মতই, কখন উঠবে কখন পড়বে আগে থাকতে আন্দাজ করা শক্ত। ক্যাপ্টেনের কথা শুনে এক মুহূর্ত চুপ করে রইল সে। তারপর বলল:
হ্যাঁ, স্যার, দেখিয়েছিলেন।
তাহলে অকাজে সময় নষ্ট করছ কেন?
লাল হয়ে উঠল ছুতোর মিস্ত্রীর মুখ। আমি সময় নষ্ট করছি না, স্যার, শীতল কণ্ঠে সে বলল। আপনি যেগুলো দেখিয়ে দিয়েছিলেন তার কয়েকটা কেটে দেখেছি, ওগুলো দিয়ে কাজ হবে না।
কাজ হবে না? খালি ফাঁকি দেয়ার বুদ্ধি…ঠিক বলেছি কি না, মিস্টার নেলসন?
ক্যাপ্টেন আর ছুতোর মিস্ত্রীর এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার কোন ইচ্ছা নেলসনের নেই। তাই তিনি বললেন, আমি, স্যার, গাছ গাছড়া চিনি, কিন্তু কোনটায় কেমন কাঠ হবে তা বলা আমার ক্ষমতার বাইরে।
হ্যাঁ, ছুতোর মিস্ত্রী সেটা জানে, বলল বুড়ো পার্সেল। আমি বলছি, ওই সব বড় বড় গাছ দিয়ে তক্তা বানালে কোন কাজেই আসবে না তক্তাগুলো।
ক্রোধের চরম সীমায় পৌঁছে গেছেন ব্লাই। কঠোর কণ্ঠে তিনি বললেন, বেশি কথা না বলে যেমন বলেছি সেইমত করো, পার্সেল। তোমার সাথে তর্ক করার প্রবৃত্তি নেই আমার।
ঠিক আছে, স্যার, একগুঁয়ে স্বরে বলল পার্সেল, বড় গাছই কাটছি। কিন্তু আবার আমি বলছি, তক্তাগুলো কোন কাজে আসবে না। যার যেটা কাজ, সে-ই সেটা ভাল বোঝে…
চলে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন ব্লাই। পাঁই করে ঘুরে আবার ছুতোর, মিস্ত্রীর মুখোমুখি হলেন তিনি।
বেটা বেজন্মা বুড়ো-আমার মুখে মুখে কথা! নরম্যান, তুমি এখন থেকে নেতা এখানকার। আর, পার্সেল, এক্ষুণি তুমি লেফটেন্যান্ট ক্রিশ্চিয়ানের কাছে হাজির হবে। পনেরো দিন শিকল বাঁধা অবস্থায় থাকবে।
পার্সেলকে জাহাজে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব চাপল আমার কাঁধে।
বুড়ো মিস্ত্রী রাগে কাঁপছে থর থর করে। দুহাত মুঠো পাকিয়ে বসে আছে নৌকার মাঝখানে। হঠাৎ তাকে বিড় বিড় করে বলতে শুনলাম, বেজন্মা বলল। ঠিক মত কর্তব্য পালনের পুরস্কার শিকল বাঁধা অবস্থায় থাকা! বড় বাড় বেড়েছে তোমার, ব্লাই! দাঁড়াও, ইংল্যান্ডে ফিরে নেই!
*
অ্যাডভেঞ্চার বে-তে বাকি যে কটা দিন বাউন্টি নোঙ্গর করে রইল, সাধারণ নাবিকদের দিন কাটল চরম অসন্তোষের ভেতর, আমার কাটল অস্বস্তিতে। এই অসন্তোষের পেছনে কোন কারণ যে নেই তা না। এখন মাথা পিছু যে পরিমাণ খাবার দৈনিক সরবরাহ করা হচ্ছে, পোর্টসমাউথ থেকে রওনা হয়ে আসার পর আর কখনও এত কম সরবরাহ করা হয়নি। ভ্যান ডিয়েমেনসল্যান্ড-এর যে জায়গায় আমরা নোঙ্গর ফেলেছি সেখানে খাবার মত এমন কিছু নেই যা দিয়ে। আমাদের খাদ্যাভাব কিছুটা পূরণ হতে পারে। অ্যাডভেঞ্চার বে-তে মাছ নেই। বললেই চলে। যা আছে তা এমন নিকৃষ্ট মানের যে দুএকদিন খাওয়ার পরই আর কেউ সেগুলো খেতে চাইল না। ডাঙায় পাখির সংখ্যাও খুব কম। ফলে ধরা কঠিন। বন্দুক থাকলে মারা যেত হতো, কিন্তু সাধারণ নাবিকরা ইচ্ছে করলেই পাখি শিকারের জন্যে বন্দুক তুলে নিতে পারে না। কিন্তু ব্লাই নিজে প্রতিদিনই বন্দুক কাঁধে চলে যান বনের ভেতর। ফিরে আসেন একটা বা দুটো বুনো হাঁস শিকার করে। নিজে খান সেগুলো। এটাই নাবিকদের অসন্তুষ্ট করল। সবচেয়ে বেশি। এর সঙ্গে যোগ হলো ছুতোর মিস্ত্রীকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার ব্যাপারটা। তার ওপর আছে ফ্রায়ার এবং ব্লাইয়ের ঠাণ্ডা লড়াই। একান্ত প্রয়োজন না হলে দুজন কেউ কারও সাথে কথা বলেন না। মাস্টারের সন্দেহ জাহাজের লোকদের কম খাবার দিয়ে ক্যাপ্টেন নিজের পকেট ভারী করছে। এত সব ব্যাপারের পর আমরা রওনা হওয়ার দুদিন আগে নেড় ইয়ং নামের এক মিডশিপম্যানকে কামানের সঙ্গে বেঁধে বারো ঘা চাবুক মারার নির্দেশ দিলেন ব্লাই।