বাউন্টি যত দক্ষিণ দিকে এগোচ্ছে ঠাণ্ডার প্রকোপ ততই বাড়ছে। ডেক এখন রীতিমত নরক হয়ে উঠেছে-আগুনের নয়, শীতের। দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে বয়ে আসা তুষার-শীতল বাতাস আমাদের হাড় পর্যন্ত জমিয়ে দিতে চায়। ভারী ভারী পশমী কাপড় পরেও পরিত্রাণ নেই। কাজের সময়টুকু কোন মতে ওপরে কাটিয়ে নিচে নামতে পারলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচে সবাই। শুধু ঠাণ্ডার কষ্ট সইতে হলে কথা ছিল না, মাঝে মাঝে ওই শীতল বাতাস বেগ বাড়তে বাড়তে হারিকেনের রূপ নেয়। তখন জীবনটাকে সত্যিই অসহনীয় মনে হয়। জাহাজ বাঁচানোর জন্যে বেশির ভাগ সময় তখন ডেকে কাটাতে হয় নাবিকদের, পাল দড়ি-দড়া ঠিক করার জন্যে মাস্তুলের মাথায় উঠতে হয় নামতে হয়। জীবনে যারা একাজ করেনি তারা বুঝতে পারবে না এতে কি কষ্ট!
প্রথম ঝড়ের দাপটটা কোন মতে সামলাল বাউন্টি, তারপর আর পারল। বাউন্টি প্রায় নতুন জাহাজ। তবু প্রবল ঝাবিক্ষুব্ধ সাগরের সাথে যুঝতে গিয়ে পর্যদস্ত হয়ে পড়ল বেচারা। খোলের জোডগুলোর অনেক জায়গায় ফাটল দেখা দিল। অবিরাম পানি সেঁচার কাজে ব্যস্ত থাকতে হলো বেশ কিছু নাবিককে। শেষ পর্যন্ত যখন সামনের ডেকেও ফাটল দেখা দিল এবং সেখান দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ফোকাসূলে পানি পড়তে লাগল তখন প্রত্যেককে যার যার হ্যামক পেছনের বড় কেবিন অর্থাৎ রুটিফল গাছের চারা নেয়ার জন্যে সাজানো হয়েছে যেটা সেটায় নিয়ে গিয়ে ঝোলানোর নির্দেশ দিলেন ব্লাই দিলেন না বলে দিতে বাধ্য হলেন বলাই বোধহয় সঙ্গত। কারণ ফোকাসূলের প্রতিটা কুঠরিরই ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ছে। একে ঠাণ্ডা তার ওপর পানির ধারা, এই অবস্থায় ফোকাসূলে থাকা সম্ভব নয় কারও পক্ষে। অবশেষে ব্লাইয়ের নিজের কেবিনের ছাদ দিয়েও যখন পানি পড়তে লাগল তখন তার ইস্পাত কঠিন সিদ্ধান্ত ভেঙে চুর চুর হয়ে গেল। হর্ন অন্তরীপ ঘুরে যাওয়ার আশা বাদ দিলেন তিনি। বাউন্টির মুখ ঘুরিয়ে দেয়া হলো পুবদিকে। অর্থাৎ এখন আমাদের লক্ষ্য উক্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ভারত মহাসাগর পেরিয়ে দক্ষিণ সাগরে পৌঁছানো। জাহাজের প্রতিটা মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল ক্যাপ্টেনের এই সিদ্ধান্তে। কয়েক দিনের মধ্যে উষ্ণ আবহাওয়ায় পৌঁছে যাবে বাউন্টি।
সত্যিই আবহাওয়ার উন্নতি হলো কয়েক দিনের মধ্যেই। ঝড় বাদল থেমে গেল, তবে ঠাণ্ডা তেমনিই আছে। তা থাক, ঠাণ্ডা তেমন কোন সমস্যা নয়, ঝড় আর বৃষ্টি না হলেই হলো। নাবিকদের মনে স্বস্তি ফিরে এল। যদিও পানি সেঁচার কাজ পুরোদমেই চালাতে হচ্ছে। হর্ন অন্তরীপ থৈকে প্রচুর সামুদ্রিক পাখি ধরেছিলাম আমরা, তখন জাহাজ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতে হয়েছে যে ওগুলো খাওয়ার সুযোগ পাইনি, এবার পেলাম। বহুদিন পর তাজা মাংসের স্বাদ পেয়ে মুখ ফিরল সবার। পেছনের বড় কেবিন থেকে আবার যে যার কুঠুরিতে ফিরে গেল।
এর ভেতর একদিন-মার্চের দশ তারিখে-খাবার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করায় খালাসী ম্যাথু কুইনটালকে চব্বিশ ঘা চাবুক মারার নির্দেশ দিলেন ব্লাই। আবার থমথমে হয়ে উঠল নাবিকদের মন।
.
মে-র তেইশ তারিখে আমরা নোঙ্গর ফেললাম আফ্রিকার উপকূলে, কেপ টাউনের কাছে এক জায়গায়। আটত্রিশ দিন এখানে রইল বাউন্টি। ডেক এবং খোলের ফাটলগুলো মেরামত করা হলো। পাল, দড়ি-দড়াও মেরামত করে নেয়া হলো। কারণ এর প্র আমরা যে পথে এগোব সে পথে ভ্যান ডিয়েমেনস ল্যান্ড-এর আগে আর কোন নোঙ্গর করার মত জায়গা বা দ্বীপ পাওয়া যাবে না। ভ্যান ডিয়েমেনস ল্যান্ড উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে প্রায় দুমাসের পথ।
মেরামত ইত্যাদি শেষ হওয়ার পর আমরা আবার পাল তুলে দিলাম। ইতোমধ্যে জুন, মাস প্রায় শেষ। তেরো বার কামান দেগে কেপ টাউনের ওলন্দাজ দুৰ্গটাকে সাহায্য এবং সহযোগিতার জন্যে ধন্যবাদ এবং সম্মান জানাল বাউন্টি। তারপর সোজা ভ্যান ডিয়েমেনস ল্যান্ড (এখনকার টাসমানিয়া)।
উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে ভ্যান ডিয়েমেনস ল্যান্ড পর্যন্ত সেই দীর্ঘ, শীতল কান্তিকর যাত্রার খুব সামান্যই আমার মনে আছে। আসলে মনে রাখবার মত তেমন কিছু ঘটেনি। দিনের পর দিন পশ্চিম এবং দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে বয়ে আসা তীব্র বাতাসের ধাক্কায় ভেসে যাওয়া আর ভেসে যাওয়া। চারদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু সাগরের নীল পানি আর পানি। ব্লাইয়ের কঠোর আচরণে ফল হয়েছে; নাবিকদের ভেতরে কোন রকম অবাধ্যতা নেই। ফলে দিনগুলো সব এক, একঘেয়ে আর নিরুত্তাপ। নিয়ম মত কাজ করে যাওয়া, আর অবসর সময়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, গল্প-গুজব করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
অগাস্টের বিশ তারিখে আমরা মিউস্টোন পাহাড় দেখতে পেলাম। ভ্যান ডিয়েমেনস ল্যান্ড-এর দক্ষিণ পশ্চিম অন্তরীপের কাছে, ডাঙা থেকে ছলিগ মত দক্ষিণ-পুবে সাগর কুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে ওটা। দুদিন পর অ্যাডভেঞ্চার বে-তে নোঙ্গর ফেলল বাউন্টি। এখানে আমরা কাটালাম প্রায় দুসপ্তাহ। কাঠ এবং পানি সংগ্রহের কাজেই প্রধানত ব্যয় হলো সময়টা। রোজ দুতোর মিস্ত্রীর তত্ত্বাবধানে গাছ কাটে একদল নাবিক, আরেক দল সেগুলো চেরাই করে তক্তা তৈরি করে অন্য এক দল চলে যায় দ্বীপের গভীরে পানি আনার জন্যে।
দ্বীপের যে অংশে আমরা নেমেছি কেমন যেন মরা মরা সে জায়গাটা। গাছ পালা আছে তবু মনে হয় নিষ্প্রাণ। বেশির ভাগ গাছই ইউক্যালিপটাস জাতীয়। সোজা উঠে গেছে। লম্বায় একশো দেড়শো ফুট, সত্তর থেকে আশি ফুট পর্যন্ত ডাল পালা শূন্য। পাতা যা তা আগার দিকে ত্রিশ চল্লিশ ফুটের ভেতর। পাখির সংখ্যা খুব কম। সারা দিনে একবার কি দুবার তাদের গান শোনা যায়। যে পনেরো দিন এখানে আমরা ছিলাম তার ভেতর বুনো জন্তু দেখেছি মাত্র একটা-অপোসাম জাতীয় খুদে এক প্রাণী, মোটা এক গাছের কোটর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিল আমাদের সাড়া পেয়ে। মানুষও দেখেছি এ জায়গায়,-সেই অপোসামটার মতই ভীতু। কালো তাদের গায়ের রঙ, শরীর সম্পূর্ণ উলঙ্গ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গলার স্বর হাঁসের মত। বেশ কয়েকবার দেখেছি ওদের। প্রত্যেকবারই চার পাঁচজনের ছোট দল। আমাদের দেখেই দৌড়ে বনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যায়।