অত বড় একটা টুকরোর ধাক্কা সামলাতে পারেনি স্যামুয়েল। চিৎ হয়ে পড়ে গেছে ডেকের ওপর। মিলস চলে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সে। নির্বিকার মুখে চলে গেল পেছন দিকে। হাঙরের টুকরোটা নিতে ভুলল না।
দ্রুত জাহাজময় ছড়িয়ে পড়ল খবরটা। এবং এই প্রথমবারের মত মিলস লক্ষ করল, সে প্রিয় হয়ে উঠেছে বাউন্টির নাবিকদের কাছে। অবশ্য এটাও বুঝতে পারছে, শাস্তি সে এড়াতে পারবে না।
ওল্ড ব্যাকাস বললেন, স্যামুয়েল খারাপ লোক সন্দেহ নেই-খুব খারাপ লোক, তবু শৃঙ্খলা লাই। যে কোন মূল্যে তা রক্ষা করবে ক্যাপ্টেন।
যা ভাবা গিয়েছিল তা-ই ঘটল। সন্ধ্যার পর পরই মিলসকে ধরে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হলো। সারা রাত থাকল ওরকম। ভোরে শুরু হলো বিচার।
ছটার ঘণ্টা পড়তেই ডেকে হাজির হলেন মিস্টার ব্লাই। ক্রিশ্চিয়ানকে বললেন সবাইকে ডাকতে, অবাধ্যতার শাস্তি কেমন দেখুক। জাহাজের সামনের দিকে চলে গেল ক্রিশ্চিয়ান। চিৎকার করে জানিয়ে দিল ক্যাপ্টেনের নির্দেশ। একটু পরেই ডেকে হাজির হলো নাবিকরা। রেলিংয়ের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেল সবাই নিঃশব্দে।
ঝাঁঝরি খাড়া করো! স্বভাবসুলভ কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন ব্লাই।
ছুতোর মিস্ত্রী আর তার সহকারীরা ধরাধরি করে দুই হ্যাঁচের মুখ থেকে তুলে আনল দুটো লম্বাটে চেহারার কাঠের ঝাঁঝরি। একটা ডেকের ওপর পেতে অন্যটা খাড়া করে দিল বাঁদিকের গ্যাংওয়ের সাথে ঠেকিয়ে।
হয়েছে, স্যার, জানাল ছুতোর মিস্ত্রী পার্সেল।
জন মিলস! হাঁক ছাড়লেন ব্লাই, সামনে এসো!
দৃঢ় পায়ে, মাথা উঁচু করে এগিয়ে এ মিলস। যে শাস্তিই দাও আমি গ্রাহ্য করি না, এমন একটা ভঙ্গি মুখে। ভুরু কুঁচকে তাকালেন ব্লাই ওর দিকে। বললেন, কিছু বলার আছে তোমার?
না, স্যার, মাথাটা সোজা রেখেই দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিল মিলস। তাহলে কাপড় খোলো, আদেশ করলেন ক্যাপ্টেন।
খুলল না, গায়ের জামাটা ছিঁড়ে এক সঙ্গীর দিকে ছুঁড়ে দিল মিলস।
খালি গায়ে এগিয়ে গেল খাড়া ঝাঁঝরির দিকে।
বাঁধো, চিৎকার করলেন ব্লাই।
দুই কোয়ার্টার মাস্টার নর্টন আর লেঙ্কলেটার এবার এগিয়ে এল। দুজনেরই হাতে লম্বা রশি। উঁচু করে ঝাঁঝরির ফাঁকের সাথে বেঁধে ফেলল ওরা মিলস-এর দুহাত।
বাঁধা হয়েছে, স্যার, জানাল নর্টন।
মাথা থেকে হ্যাট খুলে নিলেন ব্লাই। দেখাদেখি জাহাজের অন্যরাও। এবার পকেট থেকে এক কপি যুদ্ধকালীন আচরণ বিধি বের করে তার বিদ্রোহী বা বিদ্রোহাত্মক আচরণের শাস্তি সম্পর্কিত ধারাটি পড়ে শোনালেন গম্ভীর কণ্ঠে। তারপর বললেন, মিস্টার মরিসন, তিন ডজন। শুরু করো।
মরিসন লোকটা ভাল, মনে দয়া মায়া আছে। নীতিগত ভাবে সে শাস্তি হিসেবে চাবুক মারার বিরোধী। তবু ক্যাপ্টেন যখন নির্দেশ দিল চাবুক তুলে নিতে বাধ্য হলো সে। এগিয়ে গেল ঝাঁঝরির কাছে। তারপর সবার দিকে একবার তাকিয়ে মারতে লাগল সপাং সপাং করে।
প্রথমবার যখন চাবুক পিঠে পড়ল আহ! করে একবার আর্তনাদ করল মিলস। প্রথম ডজনটা পুরো হওয়ার আগে আর একটাও শব্দ করল না ও। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে গেল আঘাতগুলো।
দুহাত বুকের ওপর ভাঁজ কুঁরে দেখছেন ব্লাই। একবার শুনলাম পরিতৃপ্তির সাথে ক্রিশ্চিয়ানকে বলছেন, কে এই জাহাজের ক্যাপ্টেন দেখিয়ে তবে ছাড়ব!
তেরো বারের আঘাতটা পিঠে লাগতেই ভেঙে পড়ল মিলস-এর সহ্যক্ষমতা। এতক্ষণ দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ও ব্যথা সামলাচ্ছিল। নিচের ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে এসেছে। এবার ও চিৎকার করে উঠল, ওহ! ওই ঈশ্বর! ওহ!
দ্বিতীয় ডজন যখন শেষ হলো তখন আর শব্দ করার ক্ষমতা নেই মিলস এর। অস্পষ্ট গোঙানির মত আওয়াজ কেবল বেরোচ্ছে গলা দিয়ে। তৃতীয় ডজন শেষ হওয়ার আগেই জ্ঞান হারাল ও। কিন্তু থামল না মরিসন। ক্যাপ্টেন থামতে বলেনি সুতরাং থামতে পারে না। পুরো তিন ডজন মারার পর থামল সে। কয়েকজন নাবিক ছুটে গিয়ে বাঁধন খুলে দিল মিলস-এর! ডেকের ওপর লুটিয়ে পড়ল অচেতন দেহটা। ওল্ড ব্যাকাস এগিয়ে এসে বসলেন পাশে। প্রাথমিক পরীক্ষা শেষ করে ঘিরে থাকা নাবিকদের দিকে ফিরে শঙ্কিত কষ্টে বললেন, সিক বে-তে নিয়ে চলো!
নিঃশব্দে ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজের কেবিনের দিকে চলে গেলেন ক্যাপ্টেন।
মার্চের শুরুতে ব্লাই উষ্ণ মণ্ডলীয় আবহাওয়ার উপযোগী হালকা পোশাক আশাক তুলে রেখে ভারী এবং গরম কাপড় চোপড় বের করার নির্দেশ দিলেন। আগে থাকতেই ঠিক ছিল বাউন্টি কেপ, হন ঘুরে পশ্চিম দিকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় পড়বে, সে কারণে গরম কাপড় চোপড় আমরা সঙ্গে এনেছি। কেপ হর্ন দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত। কনকনে ঠাণ্ডা ঝড়ো বাতাস বিরামহীন ভাবে বয়ে চলেছে এখান দিয়ে। সুতরাং এ এলাকায় এসে নাবিকদের যে গরম কাপড় পরতে হবে তাতে আর সংশয় কী! শুধু পোশাক বদল না, আরও নানা দিক থেকে কেপ হর্নের শীতল ঝড়ো আবহাওয়ার মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম আমরা। পুরানো হালকা পালগুলো নামিয়ে নতুন পাল বাঁধা হলো মাস্তুলে।
ইতোমধ্যে জাহাজের মেস ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। সার্জন ওল্ড ব্যাকাস এখন আমাদের মেসের সদস্য। উনি ছাড়া স্টুয়ার্ট, হেওয়ার্ড, মরিসন এবং উদ্ভিদবিজ্ঞানী নেলসনও এই মেসে খাওয়া দাওয়া করেন-আমার সহযোগী মিডশিপম্যানরা তো আছেই। কয়েক দিনের ভেতর আমরা কজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেলাম।