প্রতিকারের আশা বৃথা বুঝতে পেরে সবাই চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করল। খাবার সম্পর্কে আর কোন অভিযোগ এর পর কেউ করেনি। তাই বলে নিজেদের ভেতর গুঞ্জন ওরা বন্ধ করেনি। স্যামুয়েলের সহযোগিতায় ভাল ভাল খাবার সব চুরি করে ওদেরকে ব্লাই খারাপ খাবার খাওয়াচ্ছে-এ ধরনের আলাপ, ওদের ভেতর চলতেই থাকল।
.
ব্রাজিল উপকূল ছাড়িয়ে প্রায় একশো লিগ আসার পর বাতাস দিক বদলে বইতে লাগল উত্তর-উত্তরপশ্চিম দিক থেকে। এর পর হঠাৎ বাতাস পড়ে গেল। তারপর হঠাৎই আবার বইতে শুরু করল। বুঝতে পারলাম, দক্ষিণ-পূর্ব বাণিজ্য বায়ুর শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি আমরা। বাতাসের এই নিত্য পরিবর্তনশীল এলাকায় দিন দুই পাল গুটিয়ে স্থির ভেসে রইল বাউন্টি। নাবিকরা সব মেতে উঠল মাছ ধরায়। বরাদ্দ সামান্য নোনা মাংসের খানিকটা বড়শিতে গেঁথে ছিপ ফেলল অনেকে; দুএকটা হাঙর বা বড়সড় মাছ যদি পাওয়া যায় এই আশায়।
হাঙর খাওয়ার কথা শুনে ডাঙার মানুষরা হয়তো নাক সিটকাবেন; কিন্তু যারা নাবিক, যারা একটু তাৰ্জা মাংস খেতে পাওয়ার আশায় দীর্ঘদিন হা পিত্যেস করে বসে থাকে তাদের কাছে হাঙরের মাংসও রীতিমত শখ করে খাওয়ার জিনিস।
অনেকের সঙ্গে বড়শি ফেলেছে গোলন্দাজের মেট, জন মিলস। বছর। চল্লিশেক বয়েস লোকটার। লম্বা, পেটা শরীর। জাহাজের একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে বড়শি ফেলেছে সে। পাশে দাঁড়িয়ে ছুতোর মিস্ত্রীর সহকারী নরম্যান
আর উদ্ভিদবিজ্ঞানীর সহকারী ব্রাউন। মোটা রশির মাথায় বড়সড় বড়শি। টোপ হিসেবে দিয়েছে সারাদিনে খাওয়ার জন্যে যেটুকু নোনা মাংস পেয়েছে ওর মেস তার প্রায় পুরোটাই। বেশ কিছুক্ষণ রশি ধরে দাঁড়িয়ে থাকার পর ভাগ্য প্রসন্ন হলো মিলস-এর। ফুট দশেক লম্বা একটা হাঙর পিঠ উঁচিয়ে চলে গেল বাউন্টির গলুইয়ের নিচ দিয়ে। রেলিংয়ের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়লাম আমি দেখার জন্যে।
কয়েক মুহূর্ত পরেই ছোট একটা ডোরাকাটা মাছ দেখতে অনেকটা ম্যাকরেলের মত-লাফিয়ে উঠল জলের ওপর।
পাইলট মাছ! চিৎকার করে উঠল নরম্যান। সাবধান এবার আসবে হাঙরটা!
চুপ, গাধা! ধমক দিল মিলস। বানরের মত লাফিও না অত-ভয় পাইয়ে দেবে তো ওকে!
দেখা গেল হাঙরটাকে। ঝকঝকে নীল জলের বুকে নোংরা মনে হচ্ছে ওটার হলদেটে শরীর। টোপ লক্ষ্য করে ছুটে এল। প্রতিটা মুখ কুঁকে পড়েছে রেলিংয়ের ওপর। চোয়াল দুটো হাঁ হলো হাঙরের। একবারে গিলে ফেলল বড়শিসুদ্ধ টোপটা।
খেয়েছে! খুশিতে চিৎকার করে উঠল মিলস। টানতে শুরু করল দড়ি। নরম্যান, ব্রাউন, ধরো, টানো! একটানে ডেকের ওপর উঠিয়ে ফেলতে হবে।
রশিটা যথেষ্ট শক্ত। মিলস আর তার দুই সহকারী টানছেও প্রাণ দিয়ে। কিছুক্ষণের ভেতর রেলিংয়ের পাশ ঘুরে ধপাস করে ডেকের ওপর আছড়ে পড়ল বেচারা হাঙর। তড়পাতে লাগল। এই ফাঁকে ছুটে গিয়ে একটা ছোট কুঠার নিয়ে এল মিলস। সর্বশক্তিতে হাঙরটার মাথায় ঘা মারল কয়েকটা। তড়পানো থেমে গেল জলদানবের। শরীর আর লেজটা কেবল কাঁপছে থির থির করে। ছসাতজন নাবিক এক সাথে হামলে পড়ল ওটার ওপর। দেখতে দেখতে মাথাটা আলাদা করে ফেলল বড় ছুরি দিয়ে, শরীরটা কেটে ফেলল টুকরো টুকরো করে। তারপর সাগর থেকে বালতি ভরে পানি তুলে ধুয়ে ফেলা হলো ডেক। পরিতৃপ্তির হাসি মিলস-এর মুখে। নাবিকদের ভেতর হাঙরের টুকরো বিলি করতে বসল সে এবার। এই সময় ক্যাপ্টেনের কেরানী গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এল তার দিকে।
চমৎকার জিনিস, তোষামুদে স্বরে সে বলল। ধরেছও দারুণ বুদ্ধি খাঁটিয়ে। আমাকে এক টুকরো দেবে তো, না?
বাউন্টির আর সব নাবিকের মত মিলসও অন্তর থেকে ঘৃণা করে স্যামুয়েলকে। লোকটা পানি ছাড়া আর কিছু পান করে না। সবার সন্দেহ, নিজের ভাগের মদ ও জমাচ্ছে দেশে ফিরে বিক্রি করবে বলে।
একটা টুকরো তাহলে চাই তোমার, হ্যাঁ? গরগরিয়ে উঠল গোলন্দাজের মেট। ঠিক আছে দেব, কিন্তু বদলে আমাকে এক বোতল মদ দেবে তুমি, যে সে জিনিস হলে চলবে না, ভাল জিনিস দিতে হবে, তা না হলে আজ হাঙর খাওয়ার আশা তোমাকে ছাড়তে হবে।
কেন ভাই এমন কৃপণের মত ব্যবহার করছ, আগের মতই মধুর স্বরে বলল স্যামুয়েল। তোমার একার ভাগে যা রেখেছ তা দিয়েই তো ডজন খানেক লোককে খাওয়াতে পারবে।
আর তোমার ভাগের মদ বা এতদিন জমিয়েছ তা দিয়ে তো হাজার খানেক লোককে খাওয়াতে পারবে।
শোনো, ভাই মিলস, আমি নিজের জন্যে চাইছি না, চাইছি ক্যাপ্টেনের জন্যে।
এতই যদি দরদ, নিজে একখানা ধরে খাওয়াও না ক্যাপ্টেনকে। এটা আমার, আমি ধরৈছি, আমার যাকে ইচ্ছা দেব, যাকে ইচ্ছা নয় দেব না। ক্যাপ্টেন তো সব খাবারের ভাল ভালগুলো খাচ্ছে, আমাদের খাওয়াচ্ছে রদ্দিগুলো, কেন ওকে আমার ভাগের জিনিস দিতে যাব?
কার সম্পর্কে কি বলছ, বুঝে বলছ তো, মিলস। চাবুকের মত হিস করে উঠল স্যামুয়েলের গলা। কথা না বাড়িয়ে একটা টুকরো আমাকে দিয়ে দাও। ক্যাপ্টেনকে আমি কিছু বলব না।
কিছু বলবে না! এই যে-নাও তাহলে তোমার টুকরো! বলতে বলতে দশ বারো পাউন্ড ওজনের এক টুকরো কাঁচা মাছ গায়ের সবটুকু জোর দিয়ে ছুঁড়ে দিল মিলস সোজা স্যামুয়েলের মুখ বরাবর। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গেল নিচে নামার সিঁড়ির দিকে।