আমরা কুরাইশরা নিজেদের স্ত্রীগণের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিলাম। কিন্তু আমরা যখন আনসারদের মধ্যে এলাম, তখন দেখতে পেলাম, তাদের স্ত্রীগণ তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছে এবং তাদের ওপর কর্তৃত্ব করে চলছে। সুতরাং আমাদের স্ত্রীরাও তাদের দেখাদেখি সেরূপ ব্যবহার করতে লাগল। একদিন আমি আমার স্ত্রীর প্রতি নারাজ হলাম এবং তাকে উচ্চস্বরে কিছু বললাম, সেও প্রতি-উত্তর দিল। আমার কাছে এরকম প্রতি-উত্তর দেয়াটা অপছন্দ হল। সে বলল, আমি আপনার কথার পাল্টা উত্তর দিচ্ছি এতে অবাক হচ্ছেন কেন? আল্লাহর কসম, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিবিগণ তাঁর কথার মুখে মুখে পাল্টা উত্তর দিয়ে থাকেন এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এক দিন এক রাত পর্যন্ত কথা না বলে কাটান।
[উমর (রাঃ) বলেন], এ কথা শুনে আমি ঘাবড়ে গেলাম এবং আমি বললাম, তাদের মধ্যে যারা এরূপ করেছে, তারা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এরপর আমি আমার কাপড় পরিধান করলাম এবং আমার কন্যা হাফসার ঘরে প্রবেশ করলাম এবং বললামঃ হাফ্সা! তোমাদের মধ্যে থেকে কারো প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী সারা দিন রাত পর্যন্ত অসন্তুষ্ট থাকেননি? সে উত্তর করল, হ্যাঁ। আমি বললাম, তুমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছ। তোমরা কি এ ব্যাপারে ভীত হচ্ছো না যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসন্তুষ্টির কারনে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়ে যাবেন? পরিণামে তোমরা ধ্বংসের মধ্যে পড়ে যাবে। সুতরাং তুমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে অতিরিক্ত কোন জিনিস দাবি করবে না এবং তাঁর কথার প্রতি-উত্তর করবে না এবং তাঁর সাথে কথা বলা বন্ধ করবে না। তোমার যদি কোন কিছুর প্রয়োজন হয়, তবে আমার কাছে চেয়ে নেবে। আর তোমার সতীন তোমার চেয়ে অধিক রূপবতী এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অধিক প্রিয় তা যেন তোমাকে বিভ্রান্ত না করে। এখানে সতীন বলতে আয়িশা (রাঃ) কে বোঝানো হয়েছে।
উমর (রাঃ) আরও বলেন, এ সময় আমাদের মধ্যে এ কথা ছড়িয়ে পড়েছিল যে, গাস্সানের শাসনকর্তা আমাদের ওপর আক্রমণ চালাবার উদ্দেশ্যে তাদের ঘোড়াগুলোকে প্রস্তুত করেছে। আমার প্রতিবেশী আনসার তার পালার দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমত থেকে রাতে ফিরে এসে আমার দরজায় খুব জোরে করাঘাত করল এবং জিজ্ঞেস করল, আমি ঘরে আছি কিনা? আমি শঙ্কিত অবস্থায় বেরিয়ে এলাম। সে বলল, আজ একটা বিরাট ঘটনা ঘটে গেছে। আমি বললাম, সেটা কি? গাস্সানিরা কি এসে গেছে? সে বলল, না, তার চেয়ে বড় ঘটনা এবং তা ভয়ংকর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সহধর্মিণীগণকে তালাক দিয়েছেন। আমি বললাম, হাফসা তো ধ্বংস হয়ে গেল, ব্যর্থ হল। আমি আগেই ধারনা করেছিলাম, খুব শীগগীরই এরকম একটা কিছু ঘটবে।
এরপর আমি পোশাক পরিধান করলাম এবং ফজরের সালাত (নামায/নামাজ) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে আদায় করলাম। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওপরের কামরায় (মাশরুবা) একাকী আরোহণ করলেন, আমি তখন হাফ্সার কাছে গেলাম এবং তাকে কাঁদতে দেখলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কাঁদছ কেন? আমি কি তোমাকে এ ব্যাপারে পূর্বেই সতর্ক করে দেইনি? নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি তোমাদের সকলকে তালাক দিয়েছেন? সে বলল, আমি জানিনা। তিনি ওখানে ওপরের কামরায় একাকী রয়েছেন। আমি সেখান থেকে বেরিয়ে এসে মিম্বরের কাছে বসলাম। সেখানে কিছু সংখ্যক লোক বসা ছিল এবং তাদের মধ্যে অনেকেই কাঁদছিল। আমি তাদের কাছে কিছুক্ষন বসলাম, কিন্তু আমার অন্তর এ অবস্থা সহ্য করতে পারছিল না। সুতরাং যে ওপরের কামরায় নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবস্থান করছিলেন আমি সেই ওপরের কামরায় গেলাম এবং তাঁর হাবশী কালো খাদেমকে বললাম, তুমি কি উমরের জন্য নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে যাওয়ার অনুমতি এনে দেবে?
খাদেমটি গেল এবং নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে কথা বলল। ফিরে এসে উত্তর করল, আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আপনার কথা বলেছি; কিন্তু তিনি নিরুত্তর আছেন। তখন আমি ফিরে এলাম এবং যেখানে লোকজন বসা ছিল সেখানে বসলাম। কিন্তু এ অবস্থা আমার কাছে অসহ্য লাগছিল। তাই আবার এসে খাদেমকে বললাম! তুমি কি উমরের জন্য অনুমতি এনে দিবে? সে গেল এবং ফিরে এসে বলল, আমি তার কাছে আপনার কথা বলেছি; কিন্তু তিনি নিরুত্তর আছেন। সুতরাং আমি আবার ফিরে এসে মিম্বরের কাছে ঐ লোকজনের সাথে বসলাম। কিন্তু এ অবস্থা আমার কাছে অসহ্য লাগছিল। পুনরায় আমি খাদেমের কাছে গেলাম এবং বললাম, তুমি কি উমরের জন্য অনুমতি এনে দিবে? সে গেল এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে বলতে আসল, আমি আপনার কথা উল্লেখ করলাম; কিন্তু তিনি নিরুত্তর আছেন।
যখন আমি ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি, এমন সময় খাদেমটি আমাকে ডেকে বলল, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে অনুমতি দিয়েছেন। এরপর আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট প্রবেশ করে দেখলাম, তিনি খেজুরের চাটাইয়ের ওপর চাঁদরবিহীন অবস্থায় খেজুরের পাতা ভর্তি একটি বালিশে ভর দিয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর শরীরে পরিষ্কার চাটাইয়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। আমি তাকে সালাম দিলাম এবং দাঁড়ানো অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আপনি কি আপনার বিবিগণকে তালাক দিয়েছেন? তিনি আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, না (অর্থাৎ তালাক দেইনি)। আমি বললাম, আল্লাহু আকবার। এরপর আলাপটা নমনীয় করার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে থেকেই বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যদি শোনেন তাহলে বলিঃ আমরা কুরাইশগণ, মহিলাদের ওপর আমাদের প্রতিপত্তি খাটাতাম; কিন্তু আমরা মদিনায় এসে দেখলাম, এখানকার পুরুষদের ওপর নারীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিদ্যমান। এ কথা শুনে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হাসলেন।