হাদীস নং ২৮২৬
কুতাইবা রহ……….আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বাধিক সুন্দর সর্বাধিক দানশীল ও সর্বাধিক শৌর্য-বীর্যের অধিকারী ছিলেন। আনাস রা. বলেন, একবার এমন হয়েছিল যে, মদীনাবাসী রাতের বেলায় একটি আওয়াজ শুনে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু তালহা রা.-এর গদীবিহীন ঘোড়ায় আরোহণ করে তরবারী ঝুলিয়ে তাদের সম্মুখে এলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা ভয় পেয়ো না, তোমরা ভয় পেয়োনা । তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি এ ঘোড়াটিকে দ্রুতগামী পেয়েছি।
হাদীস নং ২৮২৭
মক্কী ইবনে ইবরাহীম রহ………..সালামা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি গাবাহ নামক আমার সাথে স্থানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে বের হলাম। যখন আমি গাবাহর উঁচুস্থানে পৌঁছলাম, সেখানে আমার সাথে আবদুর রাহমান ইবনে আউফ রা.-এর গোলামের সাক্ষাত হল। আমি বললাম, আশ্চর্য! তোমার কি হয়েছে? সে বলল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দুগ্ধবতী উটনীগুলো ছিনতাই হয়েছে। আমি বললাম, কারা ছিনতাই করেছে? সে বলল, গাতফান ও ফাযারাহ দুই গোত্রের লোকেরা। তখন আমি বিপদ, বিপদ বলে তিনবার চিৎকার দিলাম। আর মদীনার দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে যত লোক ছিল সকলকে আওয়ায শুনিয়ে দিলাম। এরপর আমি দ্রুত ছুটে গিয়ে ছিনতাইকারীদের পেয়ে গেলাম। তারা উটনীগুলোকে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি তাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করতে থাকলাম। আর তীর নিক্ষেপ করতে থাকলাম। আর বলতে লাগলাম, আমি আকওয়াযের পুত্র (সালামা) আর আজ কমিনাদের ধ্বংসের দিন। আমি তাদের থেকে উটগুলো ছিনিয়ে নিলাম, তখনও তারা পানি পান করতে পারেনি। আর আমি সেগুলোকে হাঁকিয়ে নিয়ে আসছিলাম। এ সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে আমার সাক্ষাত হয়, তখন আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! লোকগুলো পিপাসার্ত। আমি এত দ্রুততার সাথে কাজ সেরেছি যে, তারা পানি পান করার অবকাশ পায়নি। শীঘ্র তাদের পেছনে সৈন্য পাঠিয়ে দিন। তখন তিনি বললেন, হে ইবনে আকওয়া! তুমি তাদের উপর জয়ী হয়েছ, এখন তাদের ব্যাপারে ছাড়। তারা তাদের গোত্রের নিকট পৌঁছে গেছে, তথায় তাদের আতিথেয়তা হচ্ছে।
হাদীস নং ২৮২৮
উবাইদুল্লাহ রহ……….আবু ইসহাক রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বারা ইবনে আযিব রা.-কে জিজ্ঞাসা করল এবং বলল, হে আবু উমারাহ! আপনারা কি হুনাইনের যুদ্ধে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছিলেন? বারা রা. বললেন, (আবু ইসহাক রহ. বলেন) আর আমি তা শুনছিলাম, সেদিন তো রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেননি। আবু সুফিয়ান ইবনে হারিস রা. তাঁর খচ্চরের লাগাম ধরেছিলেন। যখন মুশরিকগণ তাকে ঘিরে ফেলল, তখন তিনি অবতরণ করলেন এবং বলতে লাগলেন, আমি আল্লাহর নবী, মিথ্যা নয়। আমি আবদুল মুত্তালিবের সন্তান। তিনি (বারা) রা. বলেন, সেদিন রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপেক্ষা সুদৃঢ় আর কাউকে দেখা যায়নি।
হাদীস নং ২৮২৯
সুলাইমান ইবনে হারব রহ…………আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরায়যার ইয়াহুদীরা সাদ ইবনে মুআয রা.-এর মিমাংসায় দুর্গ থেকে বেরিয়ে আসে, তখন রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ডেকে পাঠান। আর তিনি তখন ঘটনাস্থলের নিকটেই ছিলেন। তখন সাদ রা. একটি গাধার পিঠে আরোহণ করে আসলেন। যখন তিনি নিকটবর্তী হলেন, তখন রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা তোমাদের নেতার প্রতি দণ্ডায়মান হও। তিনি এসে রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট বসলেন। তখন তাকে বললেন, এরা তোমরা মীমাংসায় সম্মত হয়েছে। (কাজেই তুমিই তাদের ব্যাপারে ফয়সালা কর) সাদ রা. বলেন, আমি এই রায় ঘোষণা করছি যে, তাদের মধ্য থেকে যুদ্ধ করতে সক্ষমদেরকে হত্যা করা হবে এবং মহিলা ও শিশুদের বন্দী করা হবে। রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলার ফয়সালার অনুরূপ ফয়সালাই করেছে।
হাদীস নং ২৮৩০
ইসমাঈল রহ………..আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত, মক্কা বিজয়ের বছর রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথায় শিরস্ত্রাণ পরিহিত অবস্থায় প্রবেশ করেন। যখন তিনি তা খুলে ফেললেন, এক ব্যক্তি এসে বলল, ইবনে খাতাল কাবার পর্দা ধরে জড়িয়ে আছে। রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তাকে হত্যা কর।
হাদীস নং ২৮৩১
আবুল ইয়ামান রহ……….আমর ইবনে আবু সুফিয়ান রা. বলেন, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দশ ব্যক্তিকে গোয়েন্দা হিসেবে সংবাদ সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করেন এবং আসিম বিনে সাবিত আনসারীকে তাদের দলপতি নিযুক্ত করেন। যিনি আসিম ইবনে উমর ইবনে খাত্তাবের মাতামহ ছিলেন। তাঁরা রওয়ানা হয়ে গেলেন, যখন তাঁরা উসফান ও মক্কার মধ্যবর্তী হাদআত নামক স্থানে পৌঁছেন, তখন হুযায়েল গোত্রের একটি প্রশাখা যাদেরকে লেহইয়ান বলা হয় তাদের কাছে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। তারা প্রায় দুশত তীরন্দাজ ব্যক্তিকে তাদের পশ্চাদ্বাবনে প্রেরণ করে। এরা তাদের চিহ্ন অনুসরণ করে চলতে থাকে। সাহাবীগণ মদীনা থেকে সাথে নিয়ে আসা খেজুর যেখানে বসে খেয়েছিলেন, অবশেষে এরা সে স্থানে সন্ধান পেয়ে গেল, তখন এরা বলল, ইয়াসরিবের খেজুর। তখন তাঁরা একটি উঁচু স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। আর কাফিরগণ তাদের ঘিরে ফেলল এবং তাদেরকে বলতে লাগল, তোমরা অবতরণ কর ও স্বেচ্ছায় বন্দিত্ব বরণ কর। আমরা তোমাদের অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, তোমাদের মধ্য থেকে কাউকে আমরা হত্যা করব না। তখন গোয়েন্দা দলের নেতা আসিম ইবনে সাবিত রা. বললেন, আল্লাহর কসম! আমি তো আজ কাফিদের নিরাপত্তায় অবতরণ করবো না। হে আল্লাহ! আমাদের পক্ষ থেকে আপনার নবীকে সংবাদ পৌঁছিয়ে দিন। অবশেষে কাফিরগণ তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করল। আর তারা আসিম রা. সহ সাত জনকে শহীদ করল। এরপর অবশিষ্ট তিন জন খুবাইব আনসারী, যায়েদ ইবনে দাসিনা রা. ও অপর একজন তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের উপর নির্ভর করে তাদের নিকট অবতরণ করলেন। যখন কাফিররা তাদেরকে আয়ত্বে নিয়ে নিল, তখন তারা তাদের ধনুকের রশি খুলে ফেলে (সেই রশি দিয়ে) তাদের বেঁধে ফেলল। তখন তৃতীয় জন বলে উঠলেন, সূচনাতেই বিশ্বাসঘাতকা! আমি তোমাদের সাথে যাব না, আমি তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করব, যারা শাহাদাত বরণ করেছেন। কাফিরগণ তাকে তাদের সঙ্গে টেনে নিয়ে চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি যেতে অস্বীকার করেন। তখন তারা তাকে শহীদ করে ফেলে এবং তারা খুবাইব ও ইবনে দাসিনাকে নিয়ে চলে যায়। অবশেষে তাদের উভয়কে মক্কায় বিক্রয় করে ফেলে। এ বদর যুদ্ধের দিন খুবাইব রা. হারিস ইবনে আমিরকে হত্যা করেছিলেন। খুবাইব রা. কিছু দিন তাদের নিকট বন্দী থাকেন। ইবনে শিহাব রহ. বলেন, আমাকে উবায়দুল্লাহ ইবনে আয়ায অবহিত করেছেন, তাকে হারিসের কন্যা জানিয়েছে যে, যখন হারিসের পুত্রগণ খুবাইব রা.-কে শহীদ করার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিল, তখন তিনি তার নিকট থেকে ক্ষৌর কাজ সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে একটা ক্ষুর ধার চাইলেন। তখন হারিসের কন্যা তাকে একখানা ক্ষুর ধার দিল। সে (সে বলেছে) সে সময় ঘটনাক্রমে আমার এক ছেলে আমার অজ্ঞাতে খুবাইবের নিকট চলে যায় এবং আমি দেখলাম যে, আমার ছেলে খুবাইবের উরুর উপর বসে রয়েছে এবং খুবাইবের হাতে রয়েছে ক্ষুর। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। খবাইব আমার চেহারা দেখে বুঝতে পারলেন যে, আমি ভয় পাচ্ছি। তখন তিনি বললেন, তুমি কি এ ভয় করো যে, আমি এ শিশুটিকে হত্যা করে ফেলব? কখনো আমি তা করব না। (হারিসের কন্যা বলল) আল্লাহর কসম! আমি খুবাইবের ন্যায় উত্তম বন্দী কখনো দেখিনি। আল্লাহর শপথ! আমি একদিন দেখলাম, তিনি লোহার শিকলে আবদ্ধ অবস্থায় আঙ্গুর ছড়া থেকে খাচ্ছেন, যা তাঁর হাতেই ছিল। অথচ এসময় মক্কায় কোন ফলই পাওয়া যাচ্ছিল না। হারিসের কন্যা বলত, এ তো ছিল আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে প্রদত্ত জীবিকা, যা তিনি খুবাইবকে দান করেছেন। এরপর তারা খুবাইবকে শহীদ করার উদ্দেশ্যে হেরেম থেকে হিল্লের দিকে নিয়ে বের হয়ে পড়ল, তখন খুবাইব রা. তাদের বললেন, আমাকে দু’রাকআত সালাত আদায় করতে দাও। তারা তাকে সে অনুমতি দান করল। তিনি দু’রাকআত সালাত আদায় করে নিলেন। তারপর তিনি বললেন, তোমরা যদি ধারণা না করতে যে, আমি মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছি তবে আমি সালাতকে দীর্ঘয়িত করতাম। হে আল্লাহ! তাদেরকে এক এক করে ধ্বংস করুন। তারপর তিনি এ কবিতা দুটি আবৃত্তি করলেন: “যখন আমি মুসলিম হিসাবে শহীদ হচ্ছি তখন আমি কোনরূপ ভয় করি না। আল্লাহর উদ্দেশ্যে আমাকে যেখানেই মাটিতে লুটিয়ে ফেলা হোক না কেন, (তাতে আমার কিছু যায় আসেনা) আমার এ মৃত্যু আল্লাহ তা’আলার জন্যই হচ্ছে। তিনি যদি ইচ্ছা করেন, তবে আমার দেহের প্রতিটি খণ্ডিত জোড়াসমূহে বরকত সৃষ্টি করে দিবেন”। অবশেষে হারিসের পুত্র তাকে শহীদ করে ফেলে। বন্তুত যে মুসলিম ব্যক্তিকে বন্দী অবস্থায় শহীদ করা হয় তার জন্য দু’রাকআত সালাত আদায়ের এ রীতি খুবাইব রা.-ই প্রবর্তন করে গেছেন। যে দিন আসিম রা. শাহাদাত বরণ করেছিলেন, সেদিন আল্লাহ তা’আলা তাঁর দু’আ কবুল করেছিলেন। সেদিনই রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবাগণকে তাদের সংবাদ ও তাদের উপর যা যা আপতিত হয়েছিল সবই অবহিত করেছিলেন। আর যখন কুরাইশ কাফিরদেরকে এ সংবাদ পৌঁছানো হয় যে, আসিম রা.-কে শহীদ করা হয়েছে তখন তারা তাঁর নিকট এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করে, যাতে সে ব্যক্তি তাঁর মরদেহ থেকে কিছু অংশ কেটে নিযে আসে। যেন তারা তা দেখে চিনতে পারে। কারণ, বদর যুদ্ধের দিন আসমি রা. কুরাইশদের জনৈক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলেন। আসিমের মরদেহের (হেফাজতের জন্য) মৌমাছির ঝাঁক প্রেরিত হল (এই মৌমাছিরা) তাঁর দেহ আবৃত করে রেখে তাদের ষড়যন্ত্র থেকে হেফাজত করল। ফলে তারা তাঁর দেহ হতে কোন এক টুকরা গোশত কেটে নিতে সক্ষম হয়নি।