টুকুন চোখ বন্ধ করে এক ফুঁ দিল এবং মনে মনে বলল, আমি যেন ঝেং-এর বাচ্চাকে দেখতে পাই। চোখ মেলে দেখল সব মোমবাতি নিভে গেছে। তারচেয়েও বড় কথা– সে ঝেং-এর বাচ্চাটাকে দেখতে পাচ্ছে। শরীরটা মনে হচ্ছে নরম কঁচের তৈরি। চোখ দুটি হালকা গোলাপী। চারটা লম্বা কান বাতাসে তিরতির করে কাঁপছে।
টুকুন উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, ঝেং-এর বাচ্চা! ঝেং-এর বাচ্চা! ঐ দেখ ঝেং-এর বাচ্চা! আমি দেখতে পাচ্ছি।
রশিদ সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, কি বলছ টুকুন?
টুকুন বলল, একটা ঝেং-এর বাচ্চা বসে আছে বাবা। কান নাড়ছে। দেখ দেখ, কি সুন্দর করে কান নাড়ছে।
কিসের বাচ্চা বললে?
ঝেং-এর বাচ্চা।
ঝেং-এর বাচ্চা ব্যাপারটা কি?
একটা অদৃশ্য প্রাণী। এই প্রাণীটা কেউ চোখে দেখতে পারে না। এর চারটা। লম্বা লম্বা কান আছে। ও চেয়ারটায় বসে আছে বাবা।
তুমি দেখতে পাচ্ছ?
হ্যাঁ পাচ্ছি।
রশিদ সাহেব অনেকক্ষণ মন খারাপ করে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মুনাকে বললেন, এতদিন ছিল কাক। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে– ঝেং এর বাচ্চা। কি করি বল তো?
মুনা টুকুনের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন, কোথায় তোর ঝেং-এর বাচ্চা?
ঐ তো বসে আছে।
যা ধরে নিয়ে আয়। টুকুন ঝেং-এর বাচ্চা ধরতে গেল। বাচ্চা পালিয়ে গেল না। বরং হাত বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে হাতে উঠে এল। টুকন ঝেং-এর বাচ্চা কোলে নিয়ে এগিয়ে আসছে। তার বাবা-মা, দুজনই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। কারণ তাঁরা কিছুই দেখছেন না।
শিশু বিশেষজ্ঞ
০৫.
টুকুনের বাবা-মা টুকুনকে একজন শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে এসেছেন। ভদ্রলোকের নাম এম. আলম। শিশু হাসপাতালের খুব বড় ডাক্তার। গম্ভীর চেহারা হলে ও তাকে দেখে মনে হয় –তিনি মজার মজার গল্প জানেন।
টুকুনের বাবা বললেন, আমার এই ছেলেটাকে ভাল করে একটু দেখুন তো ডাক্তার সাহেব।
ডাক্তার সাহেব বললেন, কি হয়েছে ওর?
ওর মাথায় কোন সমস্যা হয়েছে কিনা সেটা দেখুন।
মাথায় সমস্যার কথা কেন বলছেন? কি খোবা, তোমার মাথা ব্যথা করে?
টুকুন বলল, না।
তাহলে সমস্যা কি তোমার? পড়া মনে থাকে না?
পড়া মনে থাকে।
মুনা বললেন, ওর বাইরে থেকে কোন সমস্যা নেই ডাক্তার সাহেব। পড়াশোনায় ভাল। বুদ্ধিমান। প্রচুর খেলাধুলা করে। হঠাৎ একদিন বলা শুরু করল– একটা কাক নাকি তার সঙ্গে কথা বলে।
মুনাকে কথা শেষ না করতে দিয়েই ডাক্তার সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বললেন, এই সামান্য কারণে তাকে আপনি আমার কাছে নিয়ে এসেছেন? আমি যখন ছোট ছিলাম, আমার পরিস্কার মনে আছে –আমি একটা টেডি বিয়ারের সঙ্গে কথা বলতাম। এটা কোন ব্যাপারই না।
রশিদ সাহেব বললেন, আমি জানি এটা কোন ব্যাপার না। আমি বা আমার স্ত্রী– আমরা কেউ তেমন গুরুত্ব দেইনি কিন্তু ইদানিং নতুন সমস্যা হয়েছে। সে বলছে তার সঙ্গে একটা ঝেং-এর বাচ্চা থাকে।
কিসের বাচ্চা?
ঝেং-এর বাচ্চা। একটি অদৃশ্য প্রাণী। যাকে কেউ দেখতে পায় না। শুধু সে দেখতে পায়।
ডাক্তার সাহেব বললেন, বলুক না। এটাকে গুরুত্ব দেয়ার কি আছে? বাচ্চাদের অনেক ধরনের ফ্যান্টাসি থাকে। একটু বুদ্ধি হলেই সব কেটে যাবে। আপনাদের চিন্তিত বোধ করার কোনই কারণ নেই।
রশিদ সাহেব বললেন, চিন্তিত বোধ করার কারণ একেবারেই যে নেই তা না। ও এখন সারাক্ষণই আছে তার ঝেং-এর বাচ্চা নিয়ে। তাকে গোসল করাচ্ছে। গা মুছে দিচ্ছে। স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা হাল্কাভাবে নেয়ার উপায় এখন আর নেই। এই যে আপনার কাছে এসেছি– আমার ছেলে তার ঝেং-এর বাচ্চা নিয়ে এসেছে।
ডাক্তার সাহেব হাসিমুখে বললেন, তাই নাকি খোকা?
টুকুন বলল, হ্যাঁ।
কোথায় সে?
ঐ তো, আপনার টেবিলে বসে আছে।
ডাক্তার সাহেব টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শূন্য টেবিল মনে হল তিনি খানিকটা হতাশ হয়েছেন। হয়ত আশা করেছিলেন কিছু দেখবেন। ডাক্তার সাহেব টুকুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ঝেং-এর বাচ্চা কি খায়?
কাগজ খায়।
সব ধরনের কাগজ খায়?
জি না। খবরের কাগজ খায় না।
টাকা খায়? টাকাও তো কাগজে ছাপা।
খেতে পারে। আমি কখনো ওকে টাকা খেতে দেইনি।
আচ্ছা, এই চকচকে নোটটা রাখলাম। দেখি ও খায় কি-না।
ডাক্তার সাহেব একটা পাঁচশ টাকার নোট টেবিলে রাখলেন।
টুকুন বলল, আপনার সামনে তো খাবে না। কেউ সামনে থাকলে খায় না।
ডাক্তার সাহেব বললেন, তুমি আদর করে বল, তুমি আদর করে বললে হয়ত খাবে।
টুকুন বলল, খাও তো টুন টুন, খাও তো।
পাঁচশ টাকার নোট পড়ে রইল। টুকুন বলল, ও খাবে না। আমরা তাকিয়ে আছি তো এই জন্যে খাবে না।
ডাক্তার সাহেব বললেন, ও তাহলে টাকা খাবে না?
টুকুন বলল, আমরা সবাই তাকিয়ে আছি তো তাই খাবে না। তাকিয়ে না থাকলে হয়ত খেয়ে ফেলত। ও খুব লাজুক।
ওর স্বভাব-চরিত্র কি বল দেখি?
শান্ত স্বভাব। খুব ভদ্র।
দাঁত আছে?
আছে। আমাদের যেমন সাদা দাঁত ওরগুলি তেমন নয়। ওরগুলি হালকা নীল।
দাঁত মেজে দিতে হয়?
আমি মাঝে মাঝে আমার টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত মেজে দেই।
মুনা বললেন, ডাক্তার সাহেব, এখন আপনি বলুন –আমরা যখন দেখি একটা ছেলে অদৃশ্য এক প্রাণীর দাঁত মেজে দিচ্ছে তখন কেমন লাগে?
ডাক্তার সাহেব মুনার কথার জবাব না দিয়ে বিস্মিত হয়ে বললেন, আমার পাঁচশ টাকার নোটটা কোথায় গেল?