একটা ঝেং-এর বাচ্চা।
কিসের বাচ্চা?
ঝেং-এর।
টুকুন বিস্মিত হয়ে বলল, কই আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
ঝেং-এর বাচ্চা চোখে দেখা যায় না, টুকুন। ঝেং-এর বাচ্চা হয় অদৃশ্য। শুধুমাত্র পাখিরাই ঝেং-এর বাচ্চা দেখতে পায়। ঝেং এর বাচ্চা ঘুরে ঘুরে বেড়াবে। খেলবে কিন্তু কেউ চোখে দেখবে না।
বাহ, কি মজা!
মজা তো বটেই। তা ছাড়া ঝেং-এর বাচ্চাগুলি কাউকে কামড়ায় না –কিছু করে না। মাঝে মাঝে শুধু সুড়সুড়ি দেয়।
হাত দিলে বোঝা যায়?
না, হাত দিয়েও কিছু বুঝবে না।
বাহ, মজা তো।
দারুণ মজা।
ঝেং-এর বাচ্চা কি খায়?
কাগজ খায়। তোমাদের বাসায় তো কাগজের অভাব নেই। বাবা লেখক মানুষ। তাছাড়া মৃদুলা তো ক্রমাগতই কাগজ ছিঁড়ছে।
ঝেং-এর বাচ্চা কি কথা বলতে পারে?
না। তবে মাঝে মাঝে খিল খিল করে হাসে। তাও খুব আস্তে। খুব মন দিয়ে না শুনলে বুঝতেও পারবে না।
ঝেং এর বাচ্চা এখন কোথায় আছে?
ও এখন তোমার বিছানায় বসে আছে।
ও দেখতে কেমন?
খুব সুন্দর। ছোট্ট উলের বলের মত। খরগোশের মত বড় বড় কান। তবে দুটা কান না, চারটা কান।
লেজ আছে?
না, লেজ নেই।
আমি ওকে কাগজ দিলে কি ও খাবে?
না। মানুষের সামনে ঝেং-এর বাচ্চা কখনো কিছু খায় না। যখন কেউ থাকে না তখন সে কপ করে কাগজ গিলে ফেলে।
ইশ, কি আশ্চর্য!
তুমি খুশি হয়েছ টুকুন?
দারুণ খুশি হয়েছি। আপনাকে ধন্যবাদ।
কাক উড়ে চলে গেল। টুকুনের ইচ্ছা করছে ঝেং-এর বাচ্চার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে। তা সম্ভব নয়। একে চোখে দেখা যায় না। টুকুন গাঢ় গলায় বলল, ঝেং-এর ছানা, আমি খুব খুশি হয়েছি। খুব খুশি। এই নাও তোমাকে কিছু কাগজ দিলাম। খিদে লাগলে খেও। আমি এখন ছোট ফুপুকে টেলিফোন করতে যাচ্ছি।
.
হ্যালো ছোট ফুপু।
কিরে টুকুন! হাঁপাচ্ছিস কেন?
দারুণ ব্যাপার হয়েছে, ছোট ফুপু।
দারুণ ব্যাপার আমারো হয়েছে। সারা সকাল সারা দুপুর ফ্লুয়িড ডায়নামিক্স পড়ে পড়ে এখন মনে করতে গিয়ে দেখি সব ভুল মেরে বসে আছি। কিছু মনে নেই। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে। তোর দারুণ ব্যাপারটা কি?
কাক এসেছিলেন।
ও আচ্ছা, এসেছে তাহলে! খালি হাতে এসেছে, না কিছু নিয়ে এসেছে?
নিয়ে এসেছেন।
কি আনল –মরা ইঁদুর, না মুরগির নাড়িভুড়ি।
উনি ঝেং-এর বাচ্চা নিয়ে এসেছেন।
কিসের বাচ্চা বললি?
ঝেং-এর বাচ্চা।
সেটা আবার কি?।
খরগোশের কানের মত লম্বা লম্বা চারটা কান আছে। গোল, উলের বলের মতো।
তুই দেখে বলছিস?
না ছোট ফুপু। ঝেং-এর বাচ্চা তো দেখা যায় না। ঝেং-এর বাচ্চা হয় অদৃশ্য।
অদৃশ্য!
হ্যাঁ অদৃশ্য। ওদের গায়ে হাতও দেয়া যায় না।
বুঝলি কি করে চারটা বড় বড় কান?
কাক বলে গেছেন।
ও আচ্ছা।
ঝেং-এর বাচ্চা কি খায় জান?
না।
কাগজ খায়। আর কিছু খায় না।
অপলা টেলিফোনেই ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, টুকুন তুই তো বুদ্ধিমান ছেলে। ক্লাসের সব পরীক্ষায় ফার্স্ট-সেকেন্ড হোস। এই বয়সেই সুকুমার রায়ের সব কবিতা মুখস্থ। তুই কি করে বিশ্বাস করিস যে ঝেং-এর বাচ্চা বলে একটা জিনিস আছে যাকে চোখে দেখা যায় না? যার গায়ে হাত দেয়া যায় না। অথচ এর চারটা খরগোশের মত লম্বা লম্বা কান। মাথা থেকে এসব ঝেড়ে ফেল। আর বাবা-মাকে ঝেং-এর বাচ্চা সম্বন্ধে কিছু বলবি না। আমার মনে হয় বললে বকা খাবি। আমি টেলিফোন রাখলাম।
ছোট ফুপু খট করে টেলিফোন রেখে দিল। টুকুন মন খারাপ করে নিজের ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে দেখল, তার বিছানার উপরে একগাদা ঘেঁড়া কাগজের একটিও নেই। নিশ্চয়ই ঝেং-এর বাচ্চা খেয়ে ফেলেছে।
টুকুন আবার ছুটে গেল টেলিফোন করতে।
হ্যালো ছোট ফুপু।
আবার কি হল?
ঝেং-এর বাচ্চা কি করেছে জান?
অপলা গম্ভীর গলায় বলল, ঝেং-এর বাচ্চা সম্পর্কে কোন কথা শুনতে চাই না। অন্য কিছু বলার থাকলে বল। আছে কিছু বলার?
না।
বেশ, তাহলে টেলিফোন নামিয়ে রাখ। আর আমাকে ডিসটার্ব করবি না। মনে থাকে যেন। আমার কিছু পড়া হয়নি। নির্ঘাৎ থার্ড ক্লাস পাব। তুই কি চাস আমি থার্ড ক্লাস পাই?
না চাই না।
তাহলে টেলিফোন নামিয়ে রাখা এবং মন দিয়ে আমার কথাটা শোন। কথাটা হচ্ছে– আবার টেলিফোন করবে না।
আচ্ছা।
খোদা হাফেজ টুকুন।
খোদা হাফেজ ছোট ফুপু।
টুকুন টেলিফোন নামিয়ে রাখল, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার টেলিফোন করল। সে জানে ছোট ফুপু খুব রাগ করবে তবুও টেলিফোন করল, কারণ আসল কথাই বলা হয়নি। ঝেং-এর বাচ্চা কাগজ খেয়ে ফেলেছে –এটাই বলা হয়নি।
হ্যালো ছোট ফুপু।
হুঁ।
আবার ফোন করেছি বলে রাগ করেছ?
করেছি। প্রচণ্ড রাগ করেছি।
আমি শুধু একটা কথা বলে টেলিফোন নামিয়ে রাখব।
বেশ বল একটা কথা।
ঝেং-এর বাচ্চা কাগজ খেয়ে ফেলেছে।
কি খেয়ে ফেলেছে?
কাগজ। আমার বিছানার উপর অনেক কাগজ ছিঁড়ে রেখেছিলাম। ঐগুলি খেয়ে ফেলেছে। এখন কোন কাগজ নেই।
শোন টুকুন– ঝেং-এর বাচ্চা কোন কাগজ খায়নি। রহিমা বুয়া ঝাঁট দিয়ে ফেলেছে। তাকে জিজ্ঞেস কর।
আচ্ছা করছি।
টুকুন কিছু জিজ্ঞেস করতে পারল না, কারণ কলিংবেল বাজছে। তার বাবা-মা চলে এসেছেন। টুকুন দৌড়ে গেল সদর দরজার দিকে।
রশিদ সাহেব মেয়েকে ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার পথে একটা কেক কিনে এনেছেন। শুধু কেক না, আটটা মোমবাতিও আছে।
রাতের খাবার শেষ হবার পর মোমবাতি জ্বালানো হল। মা বললেন, চোখ বন্ধ করে মনে মনে কিছু চাও এবং মোমবাতি ফুঁ দিয়ে নেভাও। এক ফুঁ দিয়ে নেভাও। এক ফুঁ দিয়ে নেভাতে পারলে মনের ইচ্ছা পূর্ণ হবে।