আসেনি।
কি মনে হয় তোর –আসবে?
জানি না।
এলে টেলিফোন করিস।
আচ্ছা।
টুকুন তার নিজের ঘরে চুপচাপ বসে রইল। আজ মৃদুলাও এই ঘরে নেই। তার প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লেগেছে। চোখ লাল। নাক দিয়ে ক্রমাগত পানি ঝরছে। মুনা তাকে নিয়ে যাবেন ডাক্তারের কাছে। তাকে গরম কাপড় পরানো হচ্ছে।
রশিদ সাহেব এসে টুকুনকে ডেকে তার ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন, আমার সামনে চেয়ারের উপর শান্ত হয়ে বস তো টুকুন।
টুকুন বসল।
তোমার মনটা কি খারাপ? মুখ এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন?
মনে হয় ঠাণ্ডা লাগবে।
তোমার জন্মদিন হচ্ছে না –এই জন্যে মন খারাপ না তো?
টুকুন কিছু বলল না। চুপ করে রইল। রশিদ সাহেব বললেন, তোমাকে তো আগেই বলেছি গতবারই ছিল শেষ জন্মদিন। বলিনি?
হ্যাঁ।
বুঝলে টুকুন– ঢাকা শহরে অসংখ্য ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আছে যারা এই প্রচণ্ড শীতে খোলা আকাশের নিচে ঘুমায়। গায়ে দেবার মত ওদের একটা গরম সুয়েটার পর্যন্ত নেই। সেখানে হৈচৈ করে জন্মদিন করা ঠিক না। আমি তোমার জন্মদিনের টাকা দিয়ে উলেন গরম কাপড় কিনে ওদের বিলি করেছি। ভাল করিনি?
হ্যাঁ।
তুমি মুখে অবশ্যি বলছ হ্যাঁ তবু মন খারাপ করে আছ। আজ তোমার কাছে খারাপ লাগছে কিন্তু যখন বড় হবে তখন খারাপ লাগবে না। তখন ভাল লাগবে। তখন বলবে, বাবা যা করেছেন ভাল করেছেন এদেশের সব বাবাদের এটা করা উচিত।
আমি যাই বাবা?
না বোস। আমার কথা শেষ হয়নি। আমি তোমার জন্যে একটা উপহার কিনেছি –দেখ পছন্দ হয় কি না।
বাবা টুকুনের হাতে উপহার তুলে দিলেন। কি যে সুন্দর উপহার! এত বড় একটা রঙ-তুলির বাক্স। ব্রাশই হচ্ছে তিনটা। এত বড় রঙের বাক্স মনে হয় পৃথিবীতে আর নেই। এই একটাই বোধহয় তৈরি হয়েছিল। বাবা কিনে নিয়ে এসেছেন।
পছন্দ হয়েছে টুকুন?
হ্যাঁ। খুব পছন্দ হয়েছে। খুব খুব খুব।
রশিদ সাহেব বললেন, তুলির বাক্সটা তো তোমার হাতে দেয়া যাবে না, বাবা। এটা থাকবে আমার ড্রয়ারে তালাবন্ধ। তোমার যখন ছবি আঁকতে ইচ্ছা করবে আমার সামনে বসে ছবি আঁকবে।
কেন বাবা?
কারণ তোমার হাতে রঙ-তুলি দিলেই তুমি ছবি এঁকে সারা দেয়াল ভর্তি করবে। এটা তোমাকে করতে দেয়া হবে না। এখন কি ছবি আঁকতে চাও?
না।
বেশ, আমি তাহলে ড্রয়ার তালাবন্ধ করে রাখছি।
.
টুকুনের বাবা-মা মৃদুলাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেন। টুকুন একা একা তার ঘরে বসে রইল। বাড়িতে সে অবশ্যি একা না, রহিমার মা আছে। সে রান্নাঘরে রান্না করছে। টুকুনের কিছুই ভাল লাগছে না। সুকুমার রায়ের বই নিয়ে বসল। পড়ার চেষ্টা করল।
চলে হন হন ছোটে পন পন
ঘোরে বন বন কাজে ঠন ঠন
বায়ু শন শন শীতে কন কন
কাশি খন খন ফোড়া টন টন
মাছি ভন ভন থালা ঝন ঝন
অন্য সময় এই কবিতা এত ভাল লাগত! আজ একেবারে মাথা ধরে যাচ্ছে। টুকুন বই বন্ধ করল, আর তখনি কাকটা এসে বসল জানালার পাশে। গম্ভীর গলায় বলল, শুভ জন্মদিন।
টুকুন বলল, থ্যাঙ্ক ইউ।
কাকটা বলল, গেস্টরা সব চলে গেছেন?
হু।
আমি ইচ্ছা করেই দেরি করে এলাম। লোকজনের ভিড় ভাল লাগে না। বয়স হয়েছে তো। হৈচৈ-এ মাথা ধরে যায়। কেক কাটা হয়েছে?
কেক কেনা হয়নি।
সে কি! কেন?
বাবা বললেন, আর জন্মদিন হবে না। এখন থেকে জন্মদিনের টাকায় গরীবদের গরম কাপড় কিনে দেবেন।
ও আচ্ছা।
উনি লেখক তো, এই জন্যে গরীবদের কষ্ট দেখলে তাঁর খারাপ লাগে।
এ আবার কেমন কথা? গরীবদের কষ্ট দেখলে শুধু লেখকদের কেন সবারই খারাপ লাগে। আমি তো লেখক না। আমি হলাম গিয়ে কাক। আমার নিজেরই খারাপ লাগে। যাই হোক, তুমি মন খারাপ করবে না।
মন খারাপ করিনি।
এই ত মিথ্যা কথা বললে– মুখ অন্ধকার করে বসে আছ আর মুখে বলছ মন। খারাপ করিনি। হাস তো।
টুকুন হাসলো।
কাক বলল, তোমার হাসি খুব সুবিধার লাগছে না। মনে হচ্ছে কষ্ট করে হাসছ। গল্প শুনবে? গল্প শুনতে চাইলে গল্প বলতে পারি, বলব?
বলুন।
এক দেশে ছিল এক কাক। কাকটা এক টুকরা মাংস খুঁজে পেয়ে খুব খুশি হয়ে গাছের ডালে বসল। তখন একটা শিয়াল ঠিক করল কাককে বোকা বানিয়ে মাংসটা নিতে হবে …।
এই গল্প আমি জানি। এটা ঈশপের গল্প।
ঈশপ ভূল গল্প বলেছে। আসল গল্প বলেনি। আসল গল্পটা তোমাকে শুনাচ্ছি। তারপর হল কি –শিয়ালটা বলল, কাক ভাই, কাক ভাই! কি মধুর তোমার গানের গলা! তুমি যখন সকাল বেলা কা কা সুরে গান গাও এত ভাল লাগে। ভৈরবি রাগিনীতে আর কোন পাখি এমন কা কা করতে পারে না। একমাত্র তুমিই পার। তুমি আমাকে একটা গান গেয়ে শুনাও না। গান শোনার জন্যে প্রাণ ছটফট করছে।
কাক শিয়ালের চালাকি সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলল। সে কা কা করবে আর মুখ থেকে মাংসের টুকরা নিচে পড়ে যাবে। শিয়াল সেটা খাবে মহানন্দে। কাজেই কাকটা করল কি– পায়ে নখ দিয়ে মাংসের টুকরা চেপে রেখে সুন্দর করে গান গাইল। গানের কথাগুলি হল :
কা কা কা
শিয়াল ব্যাটা বোকা, কা কা কা।
মহা বোকা, বেজায় বোকা, কা কা কা।
বুঝলে টুকুন –এটা হল আসল গল্প। ঈশপের গল্পটা নকল। তোমার বাবা তো লেখক মানুষ। তাঁকে বল তো আসল গল্পটা লিখে ফেলতে।
আচ্ছা বলব।
আর শোন, তোমার জন্মদিনে খালি হাতে আসা ঠিক হবে না দেখে সামান্য উপহার নিয়ে এসেছি। জানি না তোমার পছন্দ হবে কি না।
টুকুন আনন্দিত গলায় বলল, কি এনেছেন?