ভাল হয়েছে অসাধারণ। এখন আমার কথা শোন –ঘর পরিষ্কার কর যাতে আরাম করে দমটা ফেলতে পারি। অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি। এই ফাঁকে তোর মার সঙ্গে কথা বলে আসি।
মার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলবে না কিন্তু।
পাগল হয়েছিস? বড়দের সঙ্গে কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল।
অপলা মুনার সন্ধানে গেল। মুনা চা বানাচ্ছিলেন, অপলাকে দেখে বললেন, তুই নাকি প্রতিজ্ঞা করেছিস পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘর থেকে বের হবি না? আজ চলে এলি যে!
অপলা হাসিমুখে বলল, তোমার ছানাদের দেখতে এসেছি। কিছুদিন পর পর ওদের না দেখলে ভাল লাগে না।
অনেকদিন পর পর দেখিস বলে ভাল লাগে। আমার মত সারাক্ষণ দেখতে হলে মাথা খারাপ হয়ে যেত। ছশ টাকা খরচ করে দেয়াল ডিসটেম্পার করিয়েছি। কাকের ছবি এঁকে রেখেছে।
এত পাখি থাকতে কাক কেন?
সে তো আজকাল কাকের সঙ্গে কথা বলে! শুনিসনি কিছু?
না তো।
একটা কাক নাকি তার জানালার পাশে বসে গল্প-গুজব করে।
বাহ, কি মজা!
মুনা বিরক্ত গলায় বললেন, মজার তুই কি দেখলি? এই বয়সে মিথ্যা কথা বলা শিখছে।
কল্পনা করতে শিখছে। মিথ্যা এক জিনিস, কম্পনা ভিন্ন জিনিস। তোমরা ওকে কিছু বলো না।
মুনা চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, কল্পনা ভাল। খাপছাড়া কল্পনা ভাল না। দিনরাত কাক, কাক। বাড়িঘর ভরাচ্ছে ছবি এঁকে। তোর কথা মন দিয়ে। শুনে, তুই যাবার আগে টুকুনকে বুঝিয়ে যাবি।
আচ্ছা দেখি।
দেখাদেখি নয়, ভাল করে বুঝবি। দেয়ালে যেন ছবি আঁকা না হয় সেটাও বলবি।
এক্ষুণি বলছি।
অপলা চায়ের কাপ হাতে উঠে গেল।
টুকুন ঘর পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে। অবশ্যি মৃদুলা এখনো কাগজ ছিঁড়ে যাচ্ছে। লেখা কাগজ তার ছিঁড়তে ভাল লাগে না। ধবধবে সাদা কাগজগুলি ছিঁড়তে ইচ্ছা করে। টুকুনের ধারণা, মৃদুলা বড় হয়ে বিরাট একটা কাগজের দোকান দেবে। সুন্দর কাগজে ঘর থাকবে ভর্তি। সে মনের আনন্দে ছিঁড়বে।
.
অপলা চায়ের কাপ হাতে খাটে বসতে বসতে বলল, ও টুকুন, তুই না কি কাকের সঙ্গে কথা বলিস?
বলি তো।
তা কি নিয়ে তোদের কথাবার্তা হয়?
কোন ঠিক নেই। একেক দিন একেকটা। ঐ দিন বললেন, টুকুন, একটা গান গেয়ে শুনাও তো।
তোকে তুমি করে বলেন?
তা তো বলবেনই। বয়সে বড় না? উনার ছোট মেয়েটারও বিয়ে হয়ে গেছে।
তাহলে তো খুবই সিনিয়ার লোক! তুই তাঁকে কি ডাকিস –চাচা?
না, আমি ডাকি কাকা। চাচা ডাকতে চাচ্ছিলাম, উনি বললেন, চাচা ডাকবে না বরং কাকা ডাক। কাকা ডাকলে কাকের সঙ্গে মিল হয়, শুনতে ভাল লাগে।
অপলা গম্ভীর হয়ে বলল, উনাকে খুবই চিন্তাশীল মনে হচ্ছে।
ঠিক বলেছ, ফুপু। খুবই চিন্তশীল। প্রায়ই বলেন, দেশটার হচ্ছে কি? দেশটা তো রসাতলে যাচ্ছে।
অপলা চাপা হাসি হেসে বলল, এই কথা তো তোর বাবা সবসময় বলে। তোর বাবার কাছে শুনে শুনে শিখেনি তো?
শিখতেও পারেন। উনার স্মৃতিশক্তি ভাল। যখন যা শুনেন উনার মনে থাকে। অনেকদিন আগে একবার বলেছিলাম, ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ আমার জন্মদিন। উনার দেখি মনে আছে। আমাকে বললেন, কি খোকা, জন্মদিন হচ্ছে?
আমি বললাম, হচ্ছে।
উনি বললেন, প্রবলেম হয়ে গেল। ঐদিন রোববার পড়ে গেছে। ছুটির দিন। রোববার আমি আবার ঘুরে ফিরে বেড়াতে পছন্দ করি। আসতে পারি কি না বুঝতে পারছি না।
অপলা বলল, আসুক না আসুক, তুই দাওয়াত দিয়ে রাখ।
দাওয়াত দিয়েছি ছোট ফুপু।
ভাল করেছিস। খালি হাতে নিশ্চয়ই আসবে না। কিছু একটা নিশ্চয়ই আনবে।
টুকুন আগ্রহের সঙ্গে বলল, ছোট ফুপু, কি আনবে বলে তোমার মনে হয়?
অপলা গম্ভীর গলায় বলল, আমার ধারণা, মরা ইঁদুর-টুিদুর নিয়ে আসবে। মরা ইঁদুর ওরা খুব আনন্দ করে খায়। ওদের কাছে খুবই দামী জিনিস।
টুকুন বিস্মিত হয়ে বলল, মরা ইঁদুর দিয়ে আমি কি করব?
অপলা বলল, কি আর করবি, খাবি। তোর পেয়ারের একজন এত আগ্রহ করে একটা জিনিস দেবে, আর তুই ফেলে দিবি; তা তো হয় না।
টুকুন ছোট ফুপুর দিকে তাকিয়ে আছে। অপলা খুব চেষ্টা করছে হাসি চেপে রাখার। এক সময় আর পারল না। হো হো করে হেসে ফেলল। মৃদুলাও হাসতে শুরু করল। দুজনই হাসছে। ওদের দিকে দুঃখিত চোখে তাকিয়ে আছে টুকুন। আর তখন এক কাণ্ড হল –একটা দাঁড়কাক এসে ঝপ করে বসল জানালার শিকে। অপালার দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকিয়ে থেকে ডাকল –কা কা।
হাসি থামিয়ে অপলা বলল, এই টুকুন, তোর আংকেল এসে গেছে মনে হয়। আমাকে কিছু বলছে নাকি?
টুকুন কিছু বলল না। কাকটা আবার ডাকল –কা কা কা।
অপলা বলল, চুপ করে আছিস কেন? ও বলছে কি?
তুমি কেন হাসছ তাই জানতে চাচ্ছে।
বলে দে আমি কেন হাসছি।
আমি কিছু বলব না।
বেশ, আমিই বলে দিচ্ছি। কি বলে উনাকে ডাকব তাই ভাবছি। তোর যখন কাকা হয়, তখন আমার হবে বড় ভাই। ভাইয়া ডাকব?
তোমার যা ইচ্ছা ডাক।
অপলা জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যালো ভাইজান, আমি কোন কারণ ছাড়াই হাসছি। আপনার সঙ্গে কথা বলে ভাল লাগছে। আপনি মনে হয় টুকুনের জন্মদিনে আসবেন। খালি হাতে আসবেন না। উপহার নিয়ে আসবেন।
কাকটা বলল, কা কা কা।
অপলা বলল, আপনি আবার দলবল নিয়ে আসবেন না। একা আসবেন। এখন বরং বাড়ি চলে যান।
কাক সঙ্গে সঙ্গে উড়ে চলে গেল। অপলা দেখল টুকুন গম্ভীর হয়ে আছে। মনে হচ্ছে রাগ করেছে। তার বড় বড় চোখ ভিজে আছে। কেঁদে ফেলার আগে আগে টুকুনের চোখ এরকম হয়ে যায়। অপলা বলল, কি রে টুকুন, এরকম করে তাকিয়ে আছিস কেন? আমার উপর রাগ করেছিস?