আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে কাক গাছে বসে থাকে।
টুকুন উৎসাহে উঠে বসল, মায়ের কাছে এগিয়ে এসে বলল, আসলে কি হয়েছে জান মা, আমি তো কবিতা পড়ছিলাম, তখন কাক এসে বলল, কি পড়ছ টুকুন?
আমি বললাম, রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ছি, এখন বিরক্ত করবেন না।
তুমি তাকে আপনি করে বল?
হ্যাঁ।
আচ্ছা, তারপর উনি কি বললেন? ..
উনি বললেন, তোমাদের রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিয়ে কি কোন কবিতা লিখেছেন?
আমি বললাম, লিখেছেন। উনি তো বিশ্বকবি। বিশ্বকবিকে সবকিছু নিয়ে কবিতা লিখতে হয়। উনি তখন বললেন, দেখি আমাদের নিয়ে যেটা লিখেছেন সেটা একটু পড়তো। তখন আমি বানিয়ে বানিয়ে এই কবিতাটা বললাম।
উনি খুশি হলেন?
খুব খুশি। হাসতে হাসতে বললেন, বাহ, খুব সুন্দর লিখেছে, বৈশাখ মাসে কাক গাছে বসে থাকে। বিশ্বকবি বলেই এত সুন্দর লিখতে পেরেছেন। গ্রাম কবি, দেশ কবি হলে পারতেন না। অতি উচ্চমানের কবিতা হয়েছে।
মুনা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। মনে মনে বললেন, কি করা যায় এই ছেলেকে নিয়ে?
টুকুন বলল, মা, উনি এত খুশি হলেন যে আমাকে বললেন, টুকুন, একটা কাজ কর তো –দেয়ালে আমার একটা ছবি এঁকে তার নিচে কবিতাটা লিখে রাখ। আমি বললাম, মা রাগ করবে। দেয়ালে নতুন করে ডিসটেম্পার করা হয়েছে। তখন উনি বললেন, না, তোমার মা রাগ করবেন না। উনাকে বুঝিয়ে বললেই হবে। কথায় কথায় ছেলেমেয়েদের উপর রাগ করা ভাল না। মা, তুমি কি রাগ করেছ?
না।
বাবাকে তুমি কি বুঝিয়ে বলতে পারবে?
দেখি চেষ্টা করে পারি কিনা। তুমি এখন ঘুমাও।
.
ঘুমুতে যাবার সময় মুনা কাক এবং কাকের কবিতার কথা বললেন। চিন্তিত গলায় বললেন, ছেলেটাকে নিয়ে কি করা যায় বল তো? মাথা থেকে কাক কি করে দূর করা যায়?
রশিদ সাহেব বললেন, গরমের ছুটি হোক, ওকে নিয়ে কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে কাটিয়ে আসি। ওর এই কাক নিশ্চয়ই এত দূর যাবে না। কিছুদিন পার হলে ভুলে যাবে।
মুনা বললেন, তোমার কি মনে হয় কোন ডাক্তার-টাক্তারের সঙ্গে কথা বলা দরকার?
রশিদ সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, আরে দূর। এটা তো কোন অসুখ না যে ডাক্তার চিকিৎসা করবে। ছেলেমানুষি খেয়াল। দুদিন পর কেটে যাবে। আচ্ছা, কোন কাক কি সত্যি ওর জানালায় বসে?
মুনা বিরক্ত হয়ে বললেন, শেষ পর্যন্ত তোমারও বিশ্বাস হয়ে গেল? কাক তো। সব সময়ই বসে। জানালায় বসে, রেলিং-এ বসে।
ও পড়শোনা কেমন করছে?
ভালই করছে। ক্লাস টেস্ট হয়েছে। অংকে একশতে পেয়েছে একশ।
তাহলে মনে হয় চিন্তার কিছু নেই।
চিন্তা তো আমি করছি না। সারাদিন কাক কাক করে এই জন্যে বিরক্তি লাগে।
রশিদ সাহেব লেখা নিয়ে বসলেন। তিনি ব্যাংকে কাজ করেন, তবে সেই সঙ্গে লেখালেখিও করেন। তাঁর সব লেখাই বাচ্চাদের জন্যে। এখন একটি মজার বই লিখছেন –নাম একি কান্ড! খুব মজার একটা বই।
ছোট ফুপু
০৩.
টুকুনদের বাসায় ছোট ফুপু এসেছেন।
ছোট ফুপু পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত। কদিন পরেই তাঁর M.Sc পরীক্ষা। তাঁর দম ফেলার সময় নেই। তিনি বাসায় ঢুকেই বললেন, ও টুকুন, তোদের বাড়িতে দম ফেলতে এসেছি।
টুকুনের এত ভাল লাগল। ছোট ফুপুকে তার খুব ভাল লাগে। তার কাছে মনে হয় এরকম মেয়ে অন্য কোন গ্রহে হয়ত আছে। কিন্তু পৃথিবীতে আর নেই। আর দেখতেও কি সুন্দর। শুধু তাকিয়ে থাকতে হয়।
ছোট ফুপু যখন বড়দের সঙ্গে কথা বলেন তখন তাঁকে বড়দের মত লাগে, যখন ছোটদের সঙ্গে কথা বলেন তখন ছোটদের মত লাগে। তিনি বাসায় এলে কিছুক্ষণ টুকুন এবং মৃদুলার সঙ্গে খেলবেন। মৃদুলাকে বলবেন, কই রে মৃদু, তোর বারবি নিয়ে আয়, এখন কিছুক্ষণ পুতুল খেলব। আয়, আমরা বারবিকে বিয়ে দিয়ে দি। মৃদুলা বারবি আনবে না কাগজ নিয়ে আসবে। ছোটফুপু কিছুক্ষণ তার সঙ্গে কাগজ ছিঁড়বেন। মৃদুলা খিলখিল করে হাসবে, তিনিও হাসবেন। মৃদুলার সঙ্গে খেলা শেষ হলে টুকুনকে বলবেন, আয় টুকুন, এবার তোর সঙ্গে খেলি। কি খেলবি? টুকুন যদি বলে, চোর-পুলিশ খেলবে তাহলে ফুপু মুখ বাঁকিয়ে বললেন, দূর গাধা! চোর পুলিশ পুরনো খেলা, আয় নতুন কিছু খেলি। চোর-পুলিশের চেয়েও মারাত্মক– ডাকাত-পুলিশ। তুই হবি ডাকাত, আমি মহিলা পুলিশ।
এমন একজন মানুষ বাসায় এলে আনন্দে লাফাতে ইচ্ছা করে। টুকুন মনের আনন্দ চেপে রেখে বলল, কতক্ষণ থাকবে ছোট ফুপু?
দম ফেলতে যতক্ষণ লাগে ততক্ষণ থাকব। তারপর চলে যাব। এখনো কিছু পড়া হয়নি, পঁচিশ তারিখ থেকে পরীক্ষা।
দম কোথায় ফেলবে?
কোন একটা ভাল জায়গা দেখে ফেলতে হবে।
আমার ঘরে ফেলবে?
ফেলা যায়।
টুকুন এবং মৃদুলা ছোট ফুপুকে তাদের ঘরে নিয়ে এল। ছোট ফুপু ঘর দেখে আঁৎকে উঠে বললেন, ঘরটাকে তো আস্তাবল বানিয়ে রেখেছিস।
টুকুন বলল, আস্তাবল কি ছোটফুপু?
আস্তাবল হচ্ছে যেখানে ঘোড় থাকে। তোদের এই নোংরা ঘরে দম ফেলতে পারব না। দমটা বরং আটকে রাখি।
টুকুন বলল, তাই ভাল, আটকে রাখ ফুপু।
দেয়ালে এটা কিসের ছবি রে টুকুন?
কাকের ছবি। ভাল হয়েছে না?
মোটামুটি হয়েছে। দেয়ালে ছবি আঁকার জন্যে বকা খাসনি?
না।
ছবির নিচে এটা কি কবিতা নাকি?
হু।
কবিতাটাও তো অসাধারণ হয়েছে রে– অসাধারণ। তোর লেখা না রবীন্দ্রনাথের লেখা?
আমরা দুজনে মিলে লিখেছি।