ওর কোন নাম নেই, বাবা। পাখিদের নাম থাকে না। মানুষদের নাম থাকে।
তোমাকে সে কি ডাকে?
নাম ধরে ডাকে। টুকুন বলে।
সে শুধু তোমার সঙ্গে কথা বলে, আমাদের সঙ্গে বলে না –এর কারণ কি?
ও ছোটদের পছন্দ করে। বড়দের পছন্দ করে না।
মৃদুলা তো ছোট। ওকে পছন্দ করে না কেন?
মৃদুলাকে সে দুচোখে দেখতে পারে না, বাবা। ঐ দিন আমাকে বলল, তোমার ছোট বোনটার এমন বিশ্রী নাম কে রেখেছে? তোমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে তার নাম রাখা উচিত ছিল উকুন। তাহলে কত ভাল হত। টুকুনের বোন উকুন।
এইসব কথা কাকটা তোমাকে বলল?
জ্বি বাবা।
আর কি বলে?
মাঝে মাঝে ইংরেজী জিজ্ঞেস করে? ঐদিন বলল টুকুন আকাশ ইংরেজী কি?
তুমি আকাশ ইংরেজী বলতে পারলে?
টুকুন খুব উৎসাহের সঙ্গে বলল, পেরেছি বাবা। বানান ও বলেছি– sky।
আচ্ছা বেশ। এখন আমার কথা মন দিয়ে শোন।
আমি খুব মন দিয়ে শুনছি, বাবা।
তুমি মোটেই মন দিয়ে কথা শুনছ না। পা নাচাচ্ছ।
কাকটা আমাকে বলেছে, টুকুন শোন, কখনো চুপচাপ বসে থাকবে না। যদি কখনো বসে থাকতে হয় তাহলে পা নাচাবে। পা নাচালে পায়ের একসারসাইজ হয়। রক্ত চলাচল ভাল হয়। পা দুটা ভাল থাকে। আমাদের যেমন পাখা, তোমাদের তেমনি পা।
রশিদ সাহেব হতাশ চোখে মুনার দিকে তাকালেন। মুনা হেসে ফেললেন। অন্যদিকে তাকিয়ে হাসি লুকানোর চেষ্টা করলেন। টুকুন যেন তাঁর হাসিমুখ দেখতে না পায়। আজ হাসাহাসি না। আজ টুকুনকে গম্ভীর মুখে কিছু কথা বুঝিয়ে দেয়া হবে।
রশিদ সাহেব বললেন, টুকুন, তাকাও আমার দিকে। শোন কি বলছি। ছোটরা প্রায়ই বানিয়ে বানিয়ে নানান কথা বলে। এটা তেমন দোষের না। তবে তাকে স্বীকার করতে হবে — সে বানিয়ে বানিয়ে বলছে। কেউ যদি বানিয়ে কথা বলে তারপর সবাইকে বুঝাতে চায় কথাটা সত্যি তাহলে খুব সমস্যা। এটা তার অভ্যাস হয়ে যাবে। তুমিই বল, অভ্যাস হবে না?
টুকুন খুব উৎসাহের সঙ্গে বলল, অভ্যাস তো হবেই। বড় হয়েও তখন মিথ্যা কথা বলবে।
এই তো তুমি বুঝতে পারছ। কাজেই এখন থেকে তুমি আর কাক নিয়ে কিছু বলবে না। বললে তোমারও অভ্যাস হয়ে যাবে।
আমার অভ্যাস হবে না, বাবা। আমি তো আর বানিয়ে বানিয়ে বলি না।
তুমি বানিয়ে বল না?
না। যা সত্যি আমি তাই বলি।
রশিদ সাহেব হতাশ গলায় বললেন, আচ্ছা, তুমি যাও। মুনা ভাত দাও, ভাত খেয়ে নি।
খাবার টেবিলে টুকুন কি একটা বলতে যাচ্ছিল, রশিদ সাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, কাক ছাড়া অন্য যে কোন বিষয়ে তুমি কথা বলতে পার।
কাক নিয়ে কথা বলতে পারব না?
না।
টুকুন ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আচ্ছা। রশিদ সাহেব চিন্তিত মুখে ভাত খাচ্ছেন। মুনা মৃদুলাকে খাইয়ে দিচ্ছেন। সে আটটা বাজতেই ঘুমিয়ে পড়ে। প্রতি রাতেই তাকে খাওয়াতে হয় ঘুমের মধ্যে।
টুকুন মার দিকে ঝুঁকে এসে ফিস ফিস করে বলল, মা একটা মজার জিনিস জান? তুমি যেমন মৃদুলাকে খাইয়ে দিচ্ছ, কাকও ঠিক তেমনি তার ছোট বাচ্চাদের খাইয়ে দেয়। ওদের তো হাত নেই। ওরা ঠোঁট দিয়ে খাওয়ায়।
মা বললেন, একটু আগে কি বলা হয়েছে? কাক নিয়ে আর কোন কথা না। চুপ।
টুকুন ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল।
মৃদুলা এবং টুকুন
০২.
মৃদুলা এবং টুকুন এক ঘরে শোয়।
দুজনের জন্যে দুটা আলাদা খাট। রাতে মৃদুলা এই ঘরেই শোয়। তবে ঘুম ভাঙ্গলেই মায়ের ঘরে চলে যায়। তাদের ঘর এবং মার ঘরের মাঝখানে একটা দরজা। দরজা সব সময় খোলা থাকে।
মুনা এদের ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে চান। কখনো তা সম্ভব হয় না। এক একবার ঘরে ঢুকলে তাঁর কান্না পায়। দুজনে মিলে ঘরটা কি যে করে রাখে! মৃদুলা এম্নিতে খুব শান্ত এবং লক্ষী মেয়ে হলেও ঘর নোংরা করায় তার দক্ষতা অসাধারণ। সে যা করে তা হচ্ছে শান্ত মুখে কাগজ ছেঁড়া। কাগজ ছেঁড়ার সময় সে গুন গুন করে গান গায়। গানের কথা এবং সুর দুইই বিচিত্র। গানের সুরে সে নিজেই সবচে মুগ্ধ হয়। মাথা দুলিয়ে হাসে। মুনাকে রোজ কয়েকবার ঝাঁট দিয়ে কাগজ সরাতে হয়। টুকুন কাগজ ছিঁড়ে না, ছবি আঁকে। ছবি আঁকে দেয়ালে। দেয়াল ভর্তি ছবি। এক সপ্তাহ আগে তাদের ঘর নতুন করে ডিসটেম্পার করা হয়েছে। বলে দেয়া হয়েছে দেয়ালে আর কোন ছবি আঁকা যাবে না।
মুনা তাদের ঘরে মশারি খাটাতে এসে দেখেন ডিসটেম্পার করা দেয়ালে ছবি আঁকা হয়েছে। কাকের ছবি। শুধু ছবি না, ছবির নিচে কবিতা।
আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে কাক গাছে বসে থাকে।
পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি,
দুই ধারে বসে কাক ঢালু তার পাড়ি।
মুনা মশারি খাটালেন। মৃদুলার গালে চুমু খেলেন। টুকুন বড় হয়েছে বলে এখন চুমু খেতে দেয় না। তবু তিনি জোর করেই চুমু খেলেন। তিনি মশারি খুঁজতে খুঁজতে, বললেন, বাতি নিভিয়ে দেব, টুকুন?
টুকুন বলল, দাও।
ভয় করবে না তো?
না।
মুনা বাতি নিভিয়ে দিয়ে ছেলের বিছানার পাশে বসলেন। নরম গলায় বললেন, দেয়ালে ছবি তুমি একেঁছ?
হ্যাঁ। সুন্দর হয়েছে না মা?
ছেলেকে কঠিন ধমক দিতে গিয়েও দিলেন না। বেচারা ঘুমুতে যাচ্ছে, ঘুমুক। ঘুমের আগে বকা দিয়ে মন খারাপ করিয়ে দিতে চান না। সকাল বেলা দিলেই হবে। তিনি বললেন, ছবিটা ভালই হয়েছে।
কবিতা কেমন হয়েছে, মা?
কবিতা ভাল হয়েছে। কিন্তু এটা কেমন কবিতা?