রশিদ সাহেব রান্নাঘরে ঢুকে ক্লান্ত গলায় ডাকলেন, মুনা মুনা।
মুনা এল।
রশিদ সাহেব বললেন, আমাকে এক কাপ চা দাও –আর বাড়িটা একটু ঘুরে ফিরে দেখ তো তুমি কোথাও কোন পরিবর্তন দেখছ কিনা। মনে হচ্ছে ভয়ংকর কিছু ঘটেছে।
মুনা হতভম্ব গলায় বললেন, দেয়ালের ছবিগুলি কোথায়? ছবি?
দেখা গেল –ঘরের দেয়ালে কোন ছবি নেই– ফ্রেম আছে, কিন্তু ছবি নেই। মিনিট পাঁচেক সময়ের মধ্যে তাঁরা আবিষ্কার করলেন –ঘরে কোন কাগজ নেই। এক টুকরো কাগজও নেই।
মুনা ছুটে গিয়ে স্টীলের আলমিরা খুললেন। আলমিরার ভেতর সার্টিফিকেট রাখা আছে। জমির দলিল আছে। কিছুই নেই। সংসার খরচের টাকা আলাদা করা ছিল টিনের কৌটায়। তাও নেই। পুরো বাড়ি কাগজ শূন্য।
রশিদ সাহেব বললেন, ব্যাপার কি কিছু বুঝতে পারছ?
মুনা ভীত গলায় বললেন, পারছি।
তোমার অনুমানটা কি বলতো?
মুনা ইতস্ততঃ করে বললেন, ঝেং এর বাচ্চা খেয়ে ফেলেছে।
অপলাকে টেলিফোন করে আসতে বল। এক্ষুণি আসতে বল।
ও এসে কি করবে?
সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক করতে হবে কি করা বা না করা।
মুনা বললেন, টুকুন কোথায়?
ওকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে।
কি শাস্তি?
কি শাস্তি তা পরে বলব। এখন তুমি অপলাকে আসতে বল। এক্ষুণি আসতে বল। আমার হাত-পা কাঁপছে। কি সমস্যা বলতো?
.
টুকুন একা একা বাথরুমে দাঁড়িয়ে আছে। সে ক্রমাগত কাঁদছে। শার্টের হাতায় চোখ মুছছে। ইচ্ছা করছে চিৎকার করে বলে –বাবা, এতদিন আমি যা বলেছি বানিয়ে বানিয়ে বলেছি। আর বলব না। ঝেং-এর বাচ্চা বলে কিছু নেই। সব মিথ্যা। সব মিথ্যা। আবার প্রচণ্ড অভিমানও হচ্ছে। কারণ সে জানে যা ঘটছে সবই সত্যি। মিথ্যা কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
মিষ্টি করে কে যেন ডাকল টুকুন!
টুকুন ভয়ঙ্কর চমকে উঠল। তাকিয়ে দেখে ঝেং-এর বাচ্চা বেসিনের উপর বসে আছে। অন্ধকারেও তাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সেই কি কথা বলছে? খুব হালকা গলা। ফিস ফিস করে কথা বলছে। এত অস্পষ্ট যে প্রায় বোঝাই যায় না।
তুমি কথা বলতে পার?
হু।
তাহলে এতদিন কথা বলনি কেন?
কথা বলতে আমার ভাল লাগে না। খুব কষ্ট হয়।
তাহলে এখন কথা বলছ কেন?
আমার জন্যে তুমি শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছ এই জন্যেই কথা বলছি। শোন টুকুন, আমি ঠিক করেছি –আমি চলে যাব।
কি বললে?
আমি চলে যাব।
কেন?
আমি থাকলেই তোমার নানান সমস্যা হবে। কি দরকার। তোমাকে যখন বাথরুমে দরজা বন্ধ করল তখন এমন রাগ লাগল যে তোমাদের বাসার সব কাগজ খেয়ে ফেলেছি।
সে কি?
কাজটা ঠিক হয়নি। ভুল হয়েছে। ঝেং-এর বাচ্চারা কখনো ভুল করে না। আমি রাগের কারণে ভুল করে ফেলেছি –তবে ভুল করলে ভুল শুধরানো যায়। আমি যেসব কাগজ খেয়ে ফেলেছি সব আবার ফেরত দিয়ে যাচ্ছি। যাই টুকুন।
আর কিছুক্ষণ থাক। অল্প কিছুক্ষণ।
না টুকুন। আমি যাই।
ঝেং-এর বাচ্চা চলে গেল কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ঝেং এর বাচ্চাই কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছে।
বাথরুমের দরজায় ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে।
টুকুন ভয় পেয়ে বলল, কে?
আমি, আমি দাঁড়কাক। তোমাকে এরা বাথরুমে আটকে রেখেছে শুনে খুবই মন খারাপ হল। তোমাকে সাহস দেবার জন্যে এসেছি।
আপনাকে ধন্যবাদ। আমি বাথরুমে আটকা পড়েছি আপনাকে কে বলল?
ঝেং-এর বাচ্চা বলল, ও দেখি কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছে। শোন টুকুন, আমি ঠিক করেছি আমিও আর তোমার কাছে আসব না। আমার জন্যেও তোমার সমস্যা হচ্ছে। হচ্ছে না?
হচ্ছে।
আমার মনে হয়, তোমার বাবাকে তুমি বল যে এতদিন যা বলেছ –সব বানিয়ে বানিয়ে বলেছ, আর বলবে না। তাহলে তোমার সমস্যা মিটে।
আচ্ছা বলব।
মিথ্যা কথা বলা হবে –উপায় কি! মানুষ মিথ্যাটাই সহজে বিশ্বাস করে। মানুষ বড়ই অদ্ভুত জীব।
.
বাথরুমের বাতি জ্বলে উঠল।
রশিদ সাহেবের ভয়ার্ত গলা শোনা গেল –টুকুন! টুকুন!
জি।
বেশি ভয়ে পেয়েছিস?
না বাবা।
তিনি বাথরুমের দরজা খুলে টুকুনকে কোলে তুলে নিলেন। বাবার পাশে মা দাঁড়িয়ে আছেন। মার পাশে ছোট ফুপু। তাদের পেছনে রহিমার মা। রহিমার মার কোলে মৃদুলা। মৃদুলা ঘুমুচ্ছে।
টুকুন ফুপাতে ফুপাতে বলল, এতদিন যা বলেছি সব বানিয়ে বানিয়ে বলেছি, বাবা। আর কোনদিন বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলব না।
রশিদ সাহেব অবাক হয়ে তার স্ত্রীর দিকে তাকালেন। মুনা তাকাল অপলার দিকে।
টুকুন ছোট ফুপুর দিকে তাকিয়ে বলল, ছোট ফুপু! আসলে আমিই তোমাকে মাথামোটা বলেছি। আর কোনদিন বলব না।
টুকুন শব্দ করে কাঁদতে লাগল। অপলা এসে টুকুনকে কোলে নিল। অপালার নিজের চোখেও পানি এসে গেছে। সে ইতস্ততঃ করে বলল, টুকুন, হয়ত তোর কথাই ঠিক। হয়ত ঝেং-এর বাচ্চা বলে একটা কিছু আছে যে কাগজ খায়। হয়ত আমরাই ভুল করেছি।
টুকুন বলল, তোমরা কোন ভুল করনি। সব আমার বানানো।
তারা সবাই শোবার ঘরে ঢুকল। রশিদ সাহেব দেখলেন –লেখার টেবিলে তার লেখা ঠিকঠাক আছে। আলমিরার বই সব আছে। দেয়ালের ছবিও ফিরে এসেছে –শুধু একটা ছবি উল্টো হয়ে গেছে। মাথাটা নিচের দিকে।
রশিদ সাহেব দীর্ঘ সময় উল্টো হয়ে যাওয়া ছবিটির দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, অনেকদিন ধরে আমরা কোথাও বেড়াতে যাই না। বলতে গেলে ঘরের মধ্যে বন্দি। মনে হচ্ছে এজন্যেই আমাদের সবার মাথা খানিকটা জট পাকিয়ে গেছে –দল বেঁধে সবাই সমুদ্রের কাছে গেলে কেমন হয়?