তুমি এত রেগে রেগে কথা বলছ কেন ছোট ফুপু?
রেগে রেগে কথা বলছি –কারণ আমি রেগে গেছি। তুই তোর ঐ কাকটাকে বলিস –ছোট ফুপু বলেছেন –আপনি একটা গাধা। বলতে পারবি না?
না।
না কেন?
কারণ উনি গাধা না। পাখি কখনো গাধা হয় না। ছোট ফুপু, তোমার মাথা আসলেই মোটা।
টুকুন শুনল ছোট ফুপু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। টুকুন ভয়ে ভয়ে বলল, কি হয়েছে ছোট ফুপু?
কিছু হয়নি।
তুমি কাঁদছ?
হ্যাঁ, আমি কাঁদছি। চব্বিশ বছর বয়স হয়েছে আমার। কেউ আমাকে মাথামোটা বলেনি। তুই বলেছিস। আমি কাঁদব না?
আমি বলিনি ছোট ফুপু। কাক বলেছে।
কাক-টাক সব বাজে কথা। এগুলি তোর মনের কথা।–
ছোট ফুপু টেলিফোনেই বাচ্চা মেয়েদের মত কাঁদতে লাগলেন। টুকুনের খুব মন খারাপ হল। এরকম কাণ্ড হবে সে কখনো ভাবেনি। তার নিজেরো কান্না পেতে লাগল। ছোট ফুপুকে সে যে কি ভালবাসে তা শুধু সে-ই জানে। আর কেউ জানে না।
ঝেং-এর বাচ্চাটা
০৮.
ঝেং-এর বাচ্চাটা বোধহয় টুকুনের অবস্থা বুঝতে পারে। আজ যে টুকুন মন খারাপ করেছে মনে হচ্ছে সে বুঝতে পারছে। কারণ সে ঘুরছে টুকুনের পায়ে পায়ে। টুকুন বিছনায় এসে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর সেও বিছানায় এসে টুকুনের পাশে বসে রইল। তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। টুকুন বলল,
আজ আমার খুব মন খারাপ।
ঝেং-এর বাচ্চা কান নাড়ল। যেন সে বুঝতে পারছে।
অনেকগুলি কারণে মন খারাপ। প্রথম কারণ– আমার জন্যে ছোট ফুপু আজ কেঁদেছেন। আর দ্বিতীয় কারণ, আমার কথা কেউ বিশ্বাস করছে না। বাবার ধারণা, আমি পাগল হয়ে গেছি। আচ্ছা, আমি কি পাগল হয়েছি?
ঝেং-এর বাচ্চা উত্তর দিল না। কান নাড়ল। কান নেড়ে বুঝিয়ে দিল –না।
কি করি বল তো?
ঝেং-এর বাচ্চা কিছু বলল না। টুকুন কেঁদে ফেলল। এম্নিতে সে কাঁদে না। বড় হয়েছে তো। বড় হলে কাঁদতে নেই। ঝেং-এর বাচ্চা টুকুনকে কাঁদতে দেখে বিছানা থেকে নেমে গেল। রবারের বলের মত ঝাঁপ দিয়ে পড়ল মেঝেতে। পড়েই বলের মত কয়েকবার উঠানামা করে গড়াতে গড়াতে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে টুকুন দেখল বালিশের কাছে তার রঙের বাক্স পড়ে আছে। আশ্চর্য কাণ্ড। তো! রঙের বাক্সটা বাবা ড্রয়ারে তালাবন্ধ করে রেখেছিলেন। ঝেং নিশ্চয়ই নিয়ে এসেছে। সে কি তালা না খুলেই নিয়ে এসেছে?
টুকুনের মন একটু একটু ভাল হতে শুরু করেছে। রঙ দিয়ে দেয়ালে সুন্দর একটা ছবি আঁকলে মনটা হয়তো পুরোপুরি ভাল হয়ে যাবে। ঝেং-এর বাচ্চার একটা বড় ছবি। কেউ যদি দেখতে চায় তাহলে –ছবি দেখালেই হবে।
সন্ধ্যার মধ্যে টুকুন সারা দেয়াল জুড়ে প্রকাণ্ড একটা ছবি আঁকল। কি যে সুন্দর দেখাচ্ছে ঝেং-এর বাচ্চাটাকে! গোলাপী চোখ, নীল দত। লম্বা লম্বা কান।
সন্ধ্যার পর রশিদ সাহেব ছেলের ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে দেয়ালে আঁকা ছবি দেখলেন। শান্ত গলায় বললেন, ছবি তুমি এঁকেছ টুকুন?
জি বাবা। সুন্দর হয়েছে না?
হ্যাঁ, ছবি সুন্দর হয়েছে। এটাই কি তোমার সেই বিখ্যাত ঝেং-এর বাচ্চা?
জি।
তুমি কি ড্রয়ারের তালা খুলে তোমার রঙ-তুলির বাক্স বের করেছ?
না বাবা। ঝেং-এর বাচ্চা এনে দিয়েছে।
রশিদ সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, ঝেং-এর বাচ্চা এনে দেয়নি। তুমি নিজেই। এনেছ। টেবিলের উপর চাবি ছিল। চাবি দিয়ে ড্রয়ার খুলে এনেছ। তুমি একসঙ্গে অনেকগুলি অপরাধ করেছ। প্রথম অপরাধ –আমার ড্রয়ার খুলেছ। দ্বিতীয় অপরাধ –দেয়ালে ছবি এঁকেছ। তৃতীয় অপরাধ –মিথ্যা কথা বলেছ। চতুর্থ অপরাধ– তোমার ছোট ফুপুকে মাথামোটা বলেছ।
আমি বলিনি বাবা। কাক বলেছে।
কাক কিছু বলেনি টুকুন। কাক কিছু বলতে পারে না। তুমি বানিয়ে বানিয়ে বলেছ, দোষটা দিচ্ছ কাককে। আমি বাচ্চাদের শাস্তি দিতে চাই না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তোমাকে শাস্তি দেয়া দরকার। কি শাস্তি দেয়া যায় বল তো?
আমি জানি না বাবা।
কি তুমি সবচে ভয় পাও?
বাথরুমে আটকা পড়ে গেলে আমি খুব ভয় পাই।
বেশ, তাহলে তাই করা হবে। তোমাকে বাথরুমে আটকে রাখা হবে। যতক্ষণ না তুমি সব অপরাধ স্বীকার কর ততক্ষণ বাথরুমে বন্দি থাকবে।
টুকুনের কান্না এসে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে কান্না আটকে বলল, কখন আটকাবে বাথরুমে?
এইত এখন। এসো আমার সঙ্গে?
বাতি কি নিভিয়ে দেবে, না বাতি জ্বালানো থাকবে?
বাতি নেভানো থাকবে।
টুকুন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ছোটদের এরকম শাস্তি দেয়া কি উচিত?
না, উচিত নয়। কিন্তু ছোটদেরও এ জাতীয় অপরাধ করা উচিত নয়– সে কারণেই শাস্তি। অপরাধ করলে শাস্তি হয়। অপরাধীর কোন বড় ছোট নেই। বুঝতে পারছ?
পারছি।
তিনি ছেলেকে বাথরুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন বাতি নেভাবেন না। বাথরুম অন্ধকার হলে শাস্তি বেশি হয়ে যাবে। শেষে ঠিক করলেন, নেভাবেন। কিছুটা ভয় টুকুনের পাওয়া দরকার।
রশিদ সাহেব চিন্তিত মুখে তার লেখার টেবিলে গেলেন। ছেলেটাকে নিয়ে খুব সমস্যায় পড়া গেছে। কি করা যায় কিছুই বুঝতে পারছেন না। মানসিক অশান্তির কারণে তাঁর নিজের লেখাও এগুচ্ছে না। একি কান্ড! উপন্যাসটা প্রায় শেষ করে নিয়ে এসেছেন –দ্রুত লিখছিলেন। গল্পটা সুন্দর দাঁড়া হয়েছিল। এখন আর এগুচ্ছে না।
লেখার টেবিলে বসে রশিদ সাহেব চমকে উঠলেন। লেখা কাগজগুলি নেই। তিনি টেবিলে খুঁজলেন, মেঝেতে খুঁজলেন। না, কোথাও কিছু নেই। মাঝে মাঝে মৃদুলার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে লেখার কাগজ বইয়ের আলমিরায় ঢুকিয়ে রাখেন। বোধহয় তাই করেছেন– তিনি বইয়ের আলমিরা খুললেন। না, লেখার কাগজ নেই। শুধু যে তাই — তা না আলমিরায় বইও নেই। বিরাট আলমিরা, ঠাসা ছিল বই-এ। কালও বইগুলি ছিল। রাতে শোবার সময় বই নিয়ে পড়েছেন। এখন নেই। একটি বইও নেই। কোথায় যাবে এতগুলি বই? ব্যাপারটা কি?