বখ্ত খান জুন মাসের ৯ তারিখে রামপুর পৌঁছলেন। ইউছুফ আলী খান তার হুকুম অমান্য করতে পারলেন না। মাজু খানকে ২৫শে জুন তারিখে জেলার নওয়াব ঘোষণা করে বখ্ত খান চলে গেলেন। বখ্ত খান দূরে চলে যাওয়ার পর ইউসুফ আলী খান পুনরায় সাদত আলী খানের নেতৃত্বে মুরাদাবাদ দখল করার উদ্দেশ্যে একদল সৈন্য পাঠালেন।
সদর দফতর ছাড়াও জেলার অন্যান্য অংশে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিলো। মুরাদাবাদ থেকে আমরোহার দূরত্ব দিল্লী যাওয়ার পথ ধরে বিশ মাইল মাত্র। এখানে কতিপয় সম্ভ্রান্ত প্রভাবশালী মুসলিম পরিবারের নিবাস। এটি অতিশয় প্রাচীন শহর। মে মাসের ১৭ তারিখে শহরের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ শাহ্ বিলায়েতের মাজারে গিয়ে আলোচনায় মিলিত হলেন। তার কয়েকদিন পরে গুলজার আলী নামে এক ব্যক্তি কতিপয় বিপ্লবীসহ আমরোহাতে এলেন। ফলে একটি বিদ্রোহ ঘটে গেলো। নতুন শাসন পদ্ধতি চালু করা হলো। অবশ্য তা বেশিদিন টেকেনি। কারণ উইলসন ২৫শে মে তারিখে আমরোহা আক্রমণ করলেন। অবশ্য গুলজার আলী কতিপয় সাথীসহ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।
অযোধ্যার পতনের পর রোহিলাখণ্ড প্রধান সমস্থল হয়ে দাঁড়ালো। রাজকুমার ফিরোজ শাহসহ কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহী নেতা এখানে এসেছেন। রামপুরের নওয়াব তার আপন প্রজাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন, তারা যেনো সর্ব প্রকারে রাজকুমারের বিরোধিতা করে। কিন্তু ফিরোজ শাহ্ একেবারে বিনা বাধায় শহর পুনর্দখল করেন ২১শে এপ্রিল তারিখে। তিনি প্রতিরক্ষার সুবিধার জন্য তাঁর সেনাবাহিনীকে তিনটি দলে বিভক্ত করলেন। একদলকে রামগঙ্গার তীরে স্থাপন করলেন যেনো রামপুরের দিক থেকে যে কোনো সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে নগর রক্ষা করতে পারে। দ্বিতীয় দলটিকে শহরের প্রান্তদেশে শাহ বুলাকীর মাজারের সন্নিকটে স্থাপন করলেন। তৃতীয় দলটিকে দু’দলের মধ্যবর্তী স্থানে প্রস্তুত রাখা হলো। নওয়াবের সৈন্য এবং ফিরোজ শাহের সৈন্যের মধ্যে একটি ঘোরতরো যুদ্ধ হয়ে গেলো। তাতে ৬ শত নওয়াব সৈন্য মারা পড়ে। সংবাদ এলো যে বিজনৌর থেকে ব্রিগেডিয়ার জোনস এসে পড়েছেন। অগত্যা তাঁকে বাধ্য হয়ে শহর ছাড়তে হলো। ২৪শে এপ্রিল তারিখে ব্রিটিশ সৈন্য মুরাদাবাদ দখল করে নিলো। মাঞ্জু খান এবং অন্যান্য বিদ্রোহী নেতাদের হত্যা করা হলো।
রোহিলাখণ্ডের সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ঘটে শাহজাহানপুরে। এখানকার বিদ্রোহীরা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ শাহের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বাধীনে ছিলেন। এই সময়ে এলাকা রক্ষার দায়িত্ব ছিলো কর্ণেল হ্যালের উপর। ১৫০০ সৈন্যসহ আহমদ উল্লাহ্ শাহ্ ব্রিটিশ সৈন্যের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে কর্ণেল হ্যালে কারাগারের অভ্যন্তরে আত্মগোপন করে থাকেন। আহমদ উল্লাহ শাহ্ শহর অবরোধ করলেন। কর্ণেল ক্যম্পবেল ব্রিগেডিয়ার জোন্সকে নতুন সমর-সম্ভারসহ পাঠালেন। তিনি ১৮৫৮ সালের ১১ই মে তারিখে শাহজাহানপুরের উপকণ্ঠে হাজির হওয়ার পর জোনস বিদ্রোহীদের সামান্য বাধার সম্মুখীন হলেন। কিন্তু কারাগার থেকে হ্যালেকে বের করে আনতে বিশেষ বেগ পেতে হলো না। তিনি এবং হ্যালে উভয়ে হৃদয়ঙ্গম করলেন যে যথেষ্ট পরিমাণ সাহায্য না পেলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া উচিত হবে না। সুতরাং সাহায্যের জন্য বেরিলীতে লিখলেন।
অন্যদিকে সিপাহীযুদ্ধের মুখ্যনায়কবৃন্দ বেগম হজরত মহল, ইসমাইল খান, রাজকুমার ফিরোজ শাহ্, খান বাহাদুর খান সকলেই শাহজাহানপুরে এসে উপস্থিত হলেন। নানা রাও আসতে পারেননি। কারণ তিনি তাঁর পত্নীকে অত্যধিক পরিমাণে ভালোবাসতেন। সুতরাং অনিশ্চিত যুদ্ধে যাওয়ার বদলে পত্নীর হেফাজত করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত মনে করেছিলেন। ১৫ মে তারিখে বিদ্রোহী সৈন্য ব্রিটিশ সৈন্যের ওপর হামলা চালালো। জোনস অতিশয় দৃঢ়তা সহকারে বাধা দিলেন। তার পরের দিন তিনি সসৈন্যে তিলহার যাত্রা করলেন। পথে যখন শুনতে পেলেন যে মৌলবি আহমদ উল্লাহ মোহাম্মদীতে চলে গেছেন উইলসন সাহস সঞ্চয় করলেন। কলিন ক্যাম্পবেল এ রকমের বিনা বাধাতেই ১৮ তারিখে শাহজাহানপুরে প্রবেশ করলেন।
এখনো তিনি মনে করেন, বিদ্রোহীদের সঙ্গে চূড়ান্ত যুদ্ধ করার মতো সৈন্য সংখ্যা এবং সমর-সম্ভার তার নেই। কিন্তু সে জন্য তিনি অপেক্ষা করেছিলেন। বিদোহীরা তাঁকে অপেক্ষা করতে দিলো না। ব্রিটিশ সৈন্যের ওপর আবার নতুনভাবে আক্রমণ চালানো হলো। কিন্তু তাতে বিদ্রোহীদের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। আহমদ উল্লাহ শাহ্ ফতেগড়ের দিকে যাত্রা করলেন।
ব্রিটিশ সৈন্যাধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার কোকের কাছে চিঠি পাঠিয়ে তাকে তার সাহায্যার্থে আসতে নির্দেশ দান করলেন। কোক ২২শে মে তারিখে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন। দু’দিন পরে কলিন ক্যাম্পবেল ব্রিগেডিয়ার জোনসকে আহমদ উল্লাহ শাহের। নতুন দফতর মোহাম্মদী আক্রমণ করতে পাঠালেন। ব্রিটিশ সৈন্য বার্না গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছোলে বিদ্রোহী সৈন্য তাদের গোলাবর্ষণ করতে আরম্ভ করে। ব্রিটিশ সৈন্য কামান দিয়ে বন্দুকের জবাব দিলো। অধিকাংশ বিদ্রোহী সৈন্য ভারী কামানের আক্রমণ বরদাশত করতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করলো। কিন্তু গাজী সেনাদের ক্ষুদ্র দলটি ভয়ভীতি তুচ্ছ করে অবিচলিতভাবে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করে। দ্বিতীয় দিনে আহমদ উল্লাহ শাহ মোহাম্মদী অঞ্চল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। কোম্পানীর সৈন্য মোহাম্মদী দখল করে গোটা শহরটি তোপের মুখে উড়িয়ে দেয়।