মুরাদাবাদ শহরটির পত্তন হয়েছিলো সম্রাট শাহজাহানের আমলে। রোহিলাদের অধীনে আসার পর এই শহরটির দ্রুত উন্নতি ঘটে। অতি শীগগিরই একটা উল্লেখ্য বাণিজ্য কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ালো মুরাদাবাদ। রোহিলাখণ্ড যখন অযোধ্যার নওয়াবের রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত হলো ১৮০১ সালে, তখন থেকে একটি জেলা হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছিলো। ওহাবী আন্দোলনের উদ্যোক্তা সৈয়দ আহমদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে মুরাদাবাদে অনেক মুসলমান শহীদ হয়েছিলেন। মুরাদাবাদের মুসলমান জনসাধারণের মনোভাব প্রসঙ্গে ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে লেখা হয়েছে, মুসলমানেরা সামগ্রিকভাবে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি সর্বপ্রকারে বৈরী মনোভাব পোষণ করেছে। সুতরাং কোনো সন্দেহ নেই যে রোহিলাখণ্ডের আন্যন্য জেলার মতো মুরাদাবাদের মুসলমান জনগণের একটি অংশের মধ্যে যা কিছু ইংরেজ তার প্রতি প্রকিতগত ঘৃণার কারণে একটি বিদ্রোহ ঘটেছিলো। এই বিদ্রোহে যে সকল ওলেমা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁরা হলেন মৌলবি ওয়াজউদ্দিন, মৌলবি নান্নে। নামে যিনি পরিচিত ছিলেন, মৌলবি কিফায়েত আলী কাফী, মাওলানা আলম আলী এই ওলামাদের সঙ্গে স্থানীয় বিদ্রোহী নেতা মাজউদ্দিন খান এবং আব্বাস খান যোগ দিয়েছিলেন।
ক্রক্রোপ্ট উইলসন লিখেছেন, ‘মীরাটের অভ্যুত্থানের অভাবিত সংবাদ শুনে আমরা কিছু পরিমাণ হতচকিত হয়ে গেলাম। আমাদের মতো এই খবর সেপাইরাও পেয়েছিলো। স্বভাবতঃই তারা উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলো। সুতরাং প্যারেড ময়দানে সকল সেপাইদের উদ্দেশ্য করে উইলসন বললেন যে তাদের ধর্মীয় এবং অন্যান্য ব্যাপারে কোনো প্রকারের হস্তক্ষেপ করা হবে না। উইলসন মনে করেছিলেন যে তাঁর কথায় সেপাইরা পুরোপুরি শান্ত হয়ে গেছে। সুতরাং কোনা গোলমালের আশংকা নেই। দুদিন পরে সকাল দশ ঘটিকার সময় মিথ্যা পাগলাঘণ্টা বাজিয়ে ঘোষণা করা হলো যে শহরের লোকেরা সশস্ত্রে ক্যান্টনমেন্টের ওপর হামলা করতে ছুটে আসছে। উইলসন লিখেছেন, সুতরাং আমরা অস্ত্র হাতে ছাউনির বাইরে এসে শহরের লোকদের সম্ভাব্য হামলার প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। পরে প্রমাণ হলো এটা মিথ্যা বানোয়াট গুজব। তারপর ক্যান্টনমেন্টের জীবন আগের মতো চলতে লাগলো। উইলসনের পরিস্থিতির মূল্যায়ন সঠিক ছিলো না। কারণ তাঁকে আবার পরে লিখতে হয়েছে, ১৮ তারিখের রাত দেড়টার সময় ঘুম থেকে জাগিয়ে নির্দেশ দেয়া হলো যে আমাকে ৪০ জন সেপাইসহ ৪ মাইল দূরে মীরাট সড়কে গিয়ে ছাউনি ফেলে অবস্থান করছে এমন কিছু বিদ্রোহীদের আক্রমণ করতে হবে। মুজফফর নগর থেকে আগত এই সকল বিদ্রোহী সেপাই ঘুম ভেঙ্গে দেখতে পেলো যে তারা আক্রান্ত হয়েছে। আমরা ৫জন বিদ্রোহী, সেই সঙ্গে ১৬টি অস্ত্রের র্যাক এবং নগদ ১২ হাজার টাকা পেলাম। এই সময় সেপাইরা ব্যারাক লুটতরাজ করার সুযোগ পেয়েছে। ধৃত সেপাইদের মধ্যে ৫জন পালিয়ে ২৯নম্বর লাইনে ঢুকে পড়লো। আমার একজন শিখ সেপাই তাদের একজনকে গুলি করে হত্যা করলো এবং চারজনকে পুনরায় কয়েদ করে জেলখানায় রাখা হলো। এই অবস্থা দেখে ২৯নং রেজিমেন্টের কতিপয় সেপাই ক্ষিপ্ত হয়ে কারাগারে গিয়ে তাদের মুক্ত করে দিলো। এটা ছিলো একটা স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা। এর পিছনে কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছিলো না। যাহোক আবার সেদিন বিকেলে তাদেরকে কয়েদ করে জেলখানায় আটক করা হলো।’
প্যারেড ময়দানে সেপাইদের জমায়েত করে উইলসন আবার বক্তৃতা দিলেন। বাইরের দিক থেকে পরিস্থিতি সহজ স্বাভাবিক এবং শান্ত হয়ে গেলো। আসলে এই শান্ত অবস্থা ছিলো আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস মাত্র। ২৯শে মে তারিখে মুরাদাবাদের সেপাই এবং জনগণ বিদ্রোহ করে। মৌলবি ওয়াজ উদ্দিন বিদ্রোহীদের নেতা নির্বাচিত হলেন। বাহাদুর খানের নেতৃত্বে রামপুর থেকে বিপুলসংখ্যক গাজী এসে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিলো। রামগঙ্গার তীরে সবুজ পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। সর্বত্র প্রচণ্ড উত্তেজনা। ২৯ তারিখে উইলসন রামগঙ্গা অতিক্রম করে বিদ্রোহীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। বিদ্রোহীরা প্রচণ্ড বাধা দিলো, কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় তাদের নেতা মৌলবি ওয়াহাজ উদ্দিন নিহত হলেন। মৌলবি সাহেবের মৃত্যুতে সেপাইদের যে ক্ষতি হলো, তা পূরণ করার মতো কোনো ব্যক্তিত্ব ছিলো না। যাহোক বিদ্রোহী প্রচারকেরা প্রত্যেকটি ব্রিটিশ পক্ষের সেপাইদের কাছে প্রাণপ্রিয় ধর্মের নামে প্রচার কাজ অব্যাহত গতিতে চালিয়ে যেতে থাকে। যখনই সংবাদ এলো বেরিলীর সেপাইরা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কিছু পরিবর্তন হয়ে গেলো। এখন অধিকাংশ সেপাই ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। করতে লাগলো। ব্রিটিশ অফিসারেরা ভয় পেয়ে সপরিবারে নৈনিতালে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করলো।
বিদ্রোহীরা তারপরে নওয়াব মাজুদ্দিন খান ওরফে মাজু খানের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠন করলো। আসাদ আলী খানকে গোলন্দাজ বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হলো এবং মাওলানা কাফীকে সদর-আল-শরীয়তের পদ দেয়া হলো। ক্ষুদ্র রাজ্য রামপুরের নওয়াব ইউছুফ আলী খান বাহাদুর মুরাদাবাদ অ্যুত্থানের সুযোগ গ্রহণ করে ব্রিটিশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে তৎপর হয়ে উঠলেন। ব্রিটিশ কমিশনার তাঁকে জেলার শাসন কর্তৃত্ব গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছিলেন। সে অনুসারে তাঁর পিতৃব্য আবদুল আলী খানের নেতৃত্ব একদল সৈন্য পাঠিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন সহকারী সাদত আলী খান। দু’দিন পরে নওয়াব স্বয়ং এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। কিন্তু তিনি বেশিদিন অবস্থান করতে পারলেন না। কারণ এরই মধ্যে প্রচারিত হয়েছে যে দিল্লী যাওয়ার পূর্বে নওয়াবকে শাস্তি দিয়ে মাজুদ্দীনকে শাসনকর্তা হিসেবে নিষ্কণ্টক করার জন্য বখ্ত খান ছুটে আসছেন। বখ্ত খানের আগমনের সংবাদে তিনি রামপুরে পালিয়ে গেলেন।