আহমদ উল্লাহ খান এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ভূস্বামীদের কতিপয়কে সমুচিত শিক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালী মুসলমানদের সবিশেষ অনুরোধে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু অনতিবিলম্বে সংবাদ পাওয়া গেলো, একজন মুসলমানকে বিষ্ণু সরাইয়ের কাছে হিন্দুরা হত্যা করেছে। তিনি বিষ্ণু সরাই আক্রমণ করে লুট করলেন, জ্বালিয়ে দিলেন। তহশীলদার তোঁয়াব আলী যিনি শুরু থেকে নতুন শাসকদের বিরোধিতা করে আসছিলেন, তাঁকে গ্রেফতার করা হলো এবং তাঁকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হলো। স্থানীয় মুসলমান, বিশেষ করে মৌলবি মুহম্মদ আলীর বিশেষ অনুরোধে তাকে প্রাণে হত্যা করার সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হলো না। কিন্তু কড়া পাহারায় রাখার নির্দেশ বলবৎ রইলো। আগস্টের ২৬ তারিখে হলদৌড় যাওয়ার পথে মারে খান এবং শরীফুল্লাহ খানসহ নাহতাওয়ারে এসে হাজির হলেন। নাহতাওয়ার ছিলো চৌধুরীদের শক্তিশালী কেন্দ্র। বান নদীর তীরে উভয় পক্ষে একটা ছোটোখাটো খণ্ডযুদ্ধ হয়ে গেলো। এতে চৌধুরীরা পরাজিত হন। আহমদ উল্লাহ খান হলদৌড়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। কিন্তু তিনি সংকল্প পাল্টে বিজনৌরের দিকে যাত্রা করলেন। তখনো চৌধুরীদের কেউ কেউ বিজনৌরে অবস্থান করেছিলেন। আহমদ উল্লাহ খানের সম্ভাব্য আক্রমণের কথা চিন্তা করে তাঁরা আগেভাগেই বিজনৌর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
আহমদউল্লাহ খানের প্রস্থানের পর আবার চৌধুরীরা বিজনৌর আক্রমণ করে লুণ্ঠন, জ্বালানো ইত্যাদি কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। মুসলমানদের প্রতি তাঁরা এতোদূর বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ছিলেন যে তাদের সমর্থক সৈয়দ আহমদ খানকেও বিজনৌরে অবস্থান করা নিরাপদ ভাবতে পারলেন না। তিনি নীরবে চাঁদপুরে চলে গেলেন। দু’জন বিদ্রোহী নেতা রুস্তম আলী এবং সাদিক আলী ছিলেন জেলার দায়িত্বে। রাজনৈতিক মত পার্থক্য সত্ত্বেও সৈয়দ আহমদ খানকে সর্বপ্রকার সাহায্য সহযোগিতা এবং নিরাপত্তা দান করেন। হলদৌড়ের চৌধুরীরা আবার বিদ্রোহী সরকারকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে এক বিশাল সেনাবাহিনী সংগ্রহ করেন। আহমদউল্লাহ অন্যান্য কতিপয় রোহিলা খান সমভিব্যহারে আবার হলদৌড়ের দিকে যাত্রা করলেন এবং ৩০শে আগস্ট তারিখে শহর আক্রমণ করলেন। চৌধুরীদের সেনাবাহিনী সুরক্ষিত কেল্লার মধ্যে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় অবস্থান করলো। আহমদ উল্লাহ খান তাদের সামান্য ক্ষতিও করতে পারলেন না। পক্ষান্তরে তিনি নিজেই বিস্তর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলেন। অগত্যা ৩১শে আগস্ট তারিখে তিনি বিজনৌরে ফিরে যেতে বাধ্য হলেন। মাহমুদ খান চৌধুরীদের সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে ফেলার প্রয়োজনীয়তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছিলেন। কিন্তু এটাও তিনি পরিষ্কার জানতেন যে চৌধুরীরা আহমদ উল্লাহ খানকে পছন্দ করেন না। তিনি যতোদিন মোক্তার পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন, ততোদিন চৌধুরীদের সঙ্গে আপোস-মীমাংসার কোনো সম্ভাবনা নেই। আবার সে সঙ্গে তিনি আহমদ উল্লাহ খান সম্পর্কে বিদ্রোহী সেপাই এবং নেতৃবৃন্দের মনোভাব বিলকুল ওয়াকেবহাল ছিলেন। গোড়া থেকেই অপরিসীম প্রযত্ন প্রয়াসের মাধ্যমে আহমদ উল্লাহ খান বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গগুলোকে শত শিখায় জ্বালিয়ে তুলেছিলেন। তাই সকলে তাঁকে অতিশয় শ্রদ্ধার চোখে দেখতো। মাহমুদ খান সবদিক রক্ষা পাওয়ার মতো একটা পন্থা খুঁজে বের করলেন। তিনি মোক্তারের পদ একজন ব্যক্তিবিশেষের হাতে দেয়ার বদলে একটি পরিষদের উপর ন্যস্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।
আহমদ উল্লাহ খান, আহমদ ইয়ার খান, মুহম্মদ সফিউল্লাহ খান, আবদুর রহমান এবং সৈয়দ আহমদ শাহ্ প্রমুখ ব্যক্তিবৃন্দ ছিলেন এই পরিষদের সদস্য। তাতেও কিন্তু চৌধুরীদের সঙ্গে বৈরীতার অবসান ঘটলো না। তারা নতুন সরকারকে চূড়ান্ত আঘাত করার জন্য প্রতিবেশী সমস্ত জমিদারদের ঐক্যসূত্রে বেঁধে এক বিশাল সেনাবাহিনী সংগ্রহ করলেন। শফিউল্লাহ খানসহ মাহমুদ খান তাদের নাজিরাবাদে আক্রমণ করলেন। চৌধুরীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলেন। আবার মাহমুদ খান আপোস-মীমাংসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। সুতরাং যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠলো। ২২শে নভেম্বর তারিখে হলদৌড় আক্রান্ত হলো। চৌধুরীরা বীর বিক্রমে বাধা দিলেন বটে, কিন্তু পরাজয় ঠেকাতে পারলেন না। শহর তাদের দখলে চলে এলো এবং শত্রুপক্ষের নেতা রণধীর চৌধুরীকে বন্দী করে নিয়ে গেলেন।
মাহমুদ খানের সৈন্যেরা গঙ্গা অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। ১৮৫৮ সালের ৫ই জানুয়ারি রাজা হাসান মীরপুর অবরোধ করে নিজেকে নওয়াব ঘোষণা করলেন। দু’দিন পরে হলদৌড় এবং কনখল তাদের অধিকারে চলে এলো। সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে সেপাইরা রুঢ়কি আক্রমণের কথা চিন্তা করছিলেন। কিন্তু মাহমুদ খানকে তার পরিকল্পনা পাল্টাতে হলো। ৯ই জানুয়ারি তারিখে একদল ব্রিটিশ সৈন্য অতর্কিতে কনখল আক্রমণ করে বসে।
রুঢ়কির সৈন্য বাহিনীর কর্তা ব্রিগেডিয়ার জোন্স ১৮৫৮ সালের ৭ই এপ্রিল তারিখে হরিদ্বারের নিকটে গঙ্গা অতিক্রম করে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। চার মাইল অতিক্রম করার পর ভাগিনালায় তিনি বিদ্রোহীদের একটি বাধার সম্মুখীন হলেন। কিন্তু বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ আক্রমণ ঠেকাতে পারলো না। তদুপরি তাদের চারটি ভারী কামান ব্রিটিশ সৈন্যের হাতে পড়েছে। তারা নাজিয়াবাদে পালিয়ে গেলো। ব্রিটিশ সৈন্য সে অবধি ধাওয়া করলো। বিদ্রোহীরা নাজিয়াবাদ ছেড়ে চলে গেলো। কোম্পানীর সৈন্য শহর লুট করলো এবং বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দিলো। কোট কাদির গ্রাম থেকে জালালুদ্দীন খান এবং সাদউল্লাহ খানকে বন্দী করলো। তাঁদের ২৩শে এপ্রিল তারিখে গুলি করে হত্যা করা হলো। এপ্রিলের ২১ তারিখে নাগিনা কোম্পানী সৈন্যের দখলে চলে গেলো। তাদের সৈন্যের অধিকাংশই মুরাদাবাদে পালিয়ে গিয়ে ফিরোজ শাহের সাথে যোগ দিতে সক্ষম হয়েছিলো। ফিরোজ শাহ সেখানে সসৈন্যে ২১শে এপ্রিল তারিখে এসে পৌঁছেছিলেন। মাহমুদ খান পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে ধৃত হলেন এবং তাকে যাবজ্জীবন নির্বাসনদণ্ড প্রদান করা হলো। কিন্তু সে দণ্ড তাঁকে ভোগ করতে হয়নি। আন্দামানে পাঠাবার পূর্বে কারাগারেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সম্পত্তি হয়তো নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল, নয়তো সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিলো।’