খান বাহাদুর খানের পরাজয় এবং শোচনীয় মৃত্যুতেও রোহিলা শৌর্য হার মানলো না। রোহিলাখণ্ডের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রোহিলা সর্দারেরা বিদ্রোহীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে অনেকদিন পর্যন্ত ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। বেরিলীর পরে যে সকল অঞ্চলে বিদ্রোহের অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত হয় বিজনৌর হচ্ছে তার একটি। আসলে বিজনৌর ছিলো ১৭৬০-৭৬ সাল পর্যন্ত দিল্লীর দ্বিতীয় শাহ আলমের প্রধানমন্ত্রী নজীব উদ্দৌলার জায়গীরের অংশ বিশেষ। বিজনৌরের মাহমুদ খান ছিলেন নজীব উদ্দৌলার দৌহিত্র। মীরাটের অভ্যুত্থানের সংবাদ শুনে ইংরেজ কালেকটর সেক্সপীয়র সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ত্রুটি করেননি। তিনি অফিসারদের কোথাও যাওয়া বন্ধ করে সর্বক্ষণের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিলেন। বরকন্দাজদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার ব্যবস্থাও করলেন। ডেপুটি কালেকটর মুহাম্মদ রহমত খান এবং সৈয়দ আহম্মদ খানের অধীনে দুটি রক্ষীদল গঠন করে, তাদের নেতৃত্বে শহরে নৈশ টহল প্রহরা বসালেন। কিন্তু এ সকল ব্যবস্থা বিজনৌরের অধিবাসী এবং সেপাইদের রুদ্ররোষ দমন করার জন্য বলতে হয় খুবই অপ্রতুল ছিলো। বিজনৌরের কতিপয় ক্ষিপ্ত নাগরিক ছুটে গিয়ে কয়েদখানার দরোজা ভেঙ্গে কয়েদীদের মুক্ত করে দিলেন। রুটকিতে স্যাপারের পরিচালনাধীন তিন’শ সেপাই বিদ্রোহ করে ২০শে মে তারিখে বিজনৌর আগমন করে। তাদের অফিসারেরা মৌলানা আহমদুল্লাহ খান এবং মাহমুদ খানের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে ভবিষ্যতের একটি কর্মসূচী দাঁড় করান।
মাহমুদ খানের পরামর্শে সেপাইরা ২১শে মে তারিখে নাগিনা আক্রমণ করে তহশীল এবং কোষাগারের অর্থ-সম্পদ দখল করে। সৈয়দ আহমদ খান যার ওপর অর্পিত ছিলো কোষাগারের দায়িত্ব, বুদ্ধি করে আপন হাতে এক লাখ ষাট হাজার টাকা কুয়ার মধ্যে ফেলে দিয়ে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। মাহমুদ খান অর্থের আশায় নাজিরাবাদে এসেছিলেন। কিন্তু কিছুই না পেয়ে ভগ্ন মনোরথ হয়ে ফিরে গেলেন। আসার সময়ে তাঁর সঙ্গে ছিলো মাত্র ষাট-সত্তর জন অনুচর। কিন্তু প্রত্যাবর্তনের সময় পাঠানেরা তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়ে দল অনেক গুণে বড়ো করে তুললো। তার ওপর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ আদেশ জারী করেছিলো, তিনি যেন একটু দূরে শিবির স্থাপন করে মেওয়াটের দস্যুদের পাহারা দেন। এতোদিন ধরে মাহমুদ খান এই রকম একটা সুযোগেরই প্রতীক্ষা করছিলেন। পূর্ব নির্ধারিত স্থান চাঁদপুরের বদলে তিনি গ্রাম অভিমুখে যাত্রা করলেন।
বেরিলীর সংবাদ বিজনৌরে এসে পৌঁছায় জুন মাসের ৩ তারিখে। জেলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে জেলা শাসনের ভার মাহমুদ খানের ওপর ছেড়ে দেয়ার জন্য আলাপ-আলোচনা চালাতে থাকে। সৈয়দ আহমদ খান ক্ষমতা হস্তান্তরের একখানি দলিল মুসাবিদা করলে, তাতে সেক্সপীয়র ৭ই জুন তারিখে যথাবিধি স্বাক্ষর দান করলেন। ক্ষমতা গ্রহণ করার অত্যল্পকালের মধ্যেই শাসন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। আজম উল্লাহ খানকে নায়েব, আহমদ উল্লাহ খানকে সহকারি কালেকটর, আহমদ ইয়ার খানকে সৈন্যাধ্যক্ষ এবং হাবিবুল্লাহ খানকে বখশী পদ দেয়া হলো। অধিকাংশ কোম্পানীর কর্মচারীকেই নতুনভাবে নিয়োগ করা হলো। সেই কারণে তাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত কোম্পানীর প্রতি আনুগত্য পালন করেছিলেন। এই সময়ে মৌলবী মুনিরখান চারশো গাজী সেনাসহ এসে মাহমুদ খানের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। অবশ্য কিছুকাল পরে তিনি দিল্লী গমন করেন। সেখানে যুদ্ধ করতে করতে ব্রিটিশ সেনার হাতে শহীদ হন। প্রায় একমাস শানকার্য চলার পর দিল্লীর দরবারে অনুমোদনের জন্য আবেদনপত্রসহ দূত পাঠানো হলো। ১৮ই জুলাই তারিখে শাহী ফরমান সঙ্গে করে দূত ফিরে এলো। ফরমানের মর্ম হলো, আপনার আবেদন অনুসারে আপনার উপর সমস্ত জেলার শাসন কর্তৃত্ব অর্পণ করা হলো। পাক্কা সনদ প্রদান না করা পর্যন্ত আপনাকে সৈন্য এবং তহশীলদারদের মাইনে পরিশোধ করার পর রাজস্বের বাকী অর্থ জমা রাখতে হবে এবং তা আমাদের কাছে পাঠাতে হবে।
বেরিলীর খান বাহাদুর খানের মতো তাঁকেও হিন্দু ভূস্বামী সামন্তদের নিয়ে এন্তার সঙ্কটের মোকাবেলা করতে হয়। তিনি দু’সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্রিটিশ এজেন্টরা দু’সম্প্রদায়ের সম্পর্ক বিষিয়ে দেয়ার জন্য সর্বক্ষণ সর্বত্র বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছিলো। বিভিন্ন গ্রামের চৌধুরীরা সঙঘবদ্ধ হয়ে নতুন সরকারকে খাজনা দিতে অস্বীকার করলেন। এই জমিদারদের সমুচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য নায়েব আহমদ উল্লাহ খানকে পাঠানো হলো। যদিও শুরুতে তিনি কিছু সুবিধা করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে নাজিরাবাদে চলে আসতে বাধ্য হলেন। সদ্য বিজয়ী জমিদারেরা এই বিজয়ে উৎসাহী হয়ে বিজনৌর আক্রমণ করে চারদিক থেকে মাহমুদ খানকে বেষ্টন করে ফেললেন। এই সময়ে তাঁর সঙ্গে ছিলো মাত্র চারশো পদাতিক এবং ৩০/৪০ জন অশ্বারোহী সৈন্য। অধিক সংখ্যক শত্রুর দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকার বদলে নাজিয়াবাদে পশ্চাদ্ধাবন করাই অধিকতরা যুক্তিযুক্ত মনে করলেন।
চৌধুরীরা বিজনৌর দখল করে গোটা শহর লুট করলেন, আদালত গৃহ, কাঁচারীর রেকর্ডপত্র সব জ্বালিয়ে ছাই করে ফেলা হলো। মাহমুদ খান যখন চৌধুরীদের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত, এবং সেই সুযোগে স্পেশাল কমিশনার উইলসন ডেপুটি কালেকটর সৈয়দ আহমদ খান, সদর আমিন রহমত খানকে নতুনভাবে তাঁদের দায়িত্বভার গ্রহণ করার নির্দেশ দান করলেন। কিন্তু তারা বেশি দিন সে পদে বহাল থাকতে পারেননি। চৌধুরী জমিদারেরা প্রেরণা এবং সাহস সঞ্চয় করছিলেন ব্রিটিশ পক্ষ থেকে। আরেকদিন জমিদার রামদয়ালের নেতৃত্বে নাগিনা আক্রমণ করে শহর লুটপাট করলেন। এ অনাকাঙ্ক্ষিত উৎপাতে মাহমুদ খান ভীষণ নাজুক হয়ে পড়েছিলেন। দু’সম্প্রদায়ের মধ্যে সদ্ভাব বজায় রাখার যাবতীয় প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। তাদের সঙ্গে একটা যুদ্ধ অত্যাবশ্যক এবং অত্যাসন্ন হয়ে উঠলো। নাগিনা থেকে জমিদারদের তাড়িয়ে দেয়ার জন্য রহমতুল্লাহ খানকে পাঠানো হলো। তিনি রামদয়ালকে পরাস্ত করে শহর পুনরুদ্ধার করলেন। রামদয়ালের পরাজয়ের সংবাদ শুনে হলদৌড় এবং আশপাশের জমিদারবৃন্দ রামদয়ালের সাহায্যার্থে ছুটে এলো, কিন্তু সংবাদ এলো, যে নওয়াবের সৈন্যরা শহর পুনরুদ্ধার করার জন্য ধেয়ে আসছে। সৈয়দ আহমদ খান এবং তার সমর্থক চৌধুরীরা ভয়ঙ্করভাবে এস্ত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো। বালিকোটলায় আহমদ উল্লাহ খান এসে পৌঁছেছেন এ সংবাদ শ্রবণে রণধীর চৌধুরী সৈয়দ আহমদ খানকে জানালেন যে তিনি বিজনৌর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন এবং তাঁকেও তাঁর সঙ্গী হতে বললেন। ডেপুটি কালেকটর, সদর আমিন এবং রণধীর চৌধুরী একই সঙ্গে ১৮৫৭ সালের ২৪শে আগস্ট বিজনৌর ত্যাগ করেন।