বদাউনে যে সকল বিদ্রোহী নেতা সমবেত হয়েছিলেন, তারা সময় বুঝে খান বাহাদুর খানের সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য বেরিলী অভিমুখে যাত্রা করলেন। রামপুর থেকে হাকিম সায়েদুল্লা খানের নেতৃত্বে নতুন একদল সৈন্য এসে ব্রিটিশ সৈন্যের শক্তি বৃদ্ধি করলো। বদাউন পুনরায় ব্রিটিশ অধিকারে চলে গেলো এবং শরফ উদ্দিন খানকে তহশীলদার হিসাবে নিয়োগ করা হয়। যে সকল হিন্দু জমিদার, যারা শুরু থেকেই বিদ্রোহীদের বিরোধিতা করেছিলেন তাঁদের হাতে তহশীল এবং পরগণাসমূহের দায়িত্ব দেয়া হয়। দেশপ্রেমিকদের প্রতি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত কঠোর পন্থা অবলম্বন করলেন। গৃহদাহ, লুণ্ঠন যে কতো হয়েছে এবং কত জনকে যে ফাঁসিকাষ্ঠে চড়ানো হয়েছে তার সীমা সংখ্যা নেই।
তৃতীয় সেনাদলটির অধিনায়ক ওয়ালপোল ৭ই এপ্রিল তারিখে লখনৌ থেকে যাত্রা করলেন। ১৫ তারিখে ২৫০ মাইল মার্চ করে লখনৌর ১৫০ মাইল উত্তর পশ্চিমে কুনিয়াতে এসে উপনীত হলেন। এই এলাকা ছিলো এমন একজন সামন্তের শাসনাধীন যিনি চাপের মুখে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন বটে, ব্রিটিশের সঙ্গে যুদ্ধ করার সামান্যতম ইচ্ছাও তাঁর ছিলো না। একজন ধৃত সেপাই ওয়ালপেপালকে জানালো যে রাজা নৃপতি সিং ব্রিটিশ সৈন্যদের অভিবাদন জানিয়ে গ্রহণ করতে প্রস্তুত। তিনি সে গল্প বিশ্বাস না করে কেল্লা আক্রমণ করলেন। কেল্লার লোকেরা ঝড়ের বেগে আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্যে কামানের গোলা বর্ষণ করতে থাকে। আড্রিয়ান হোপ নামক একজন সাহসী ইংরেজ অফিসার গোলার আঘাতে প্রাণ হারালেন। এই তরুণ অফিসারটির মৃত্যুতে সেনাধিনায়ক ব্যথিত হলেন। নৃপতি সিং দুর্গ ছেড়ে পলায়ন করলেন। ওয়ালপোল অব্যাহত গতিতে মার্চ করে যেতে লাগলেন। এক সপ্তাহের মধ্যেই শীর্ষায় আরেকটি ছোটোখাটো যুদ্ধ করতে হলো। মে মাসের তিন তারিখে প্রধান সেনাপতির সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য মীরন কাটারায় এসে উপস্থিত হলেন। তার অধীনে এখন প্রয়োজনীয় সৈন্য এবং সে অনুপাতে অস্ত্রশস্ত্রাদি রয়েছে। আরো একদিন মার্চ করে তিনি ফরিদপুরে এসে পৌঁছলেন।
বেরিলীতে বিদ্রোহী নেতৃবৃন্দও বসেছিলেন না। তাঁরা ব্রিটিশ সৈন্যকে ঠেকাবার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিলেন। ডঃ ওয়াজির খান, যুবরাজ ফিরোজ শাহ্, নানা রাও ফারাক্কাবাদের তোফাজ্জল হোসেন এবং ফতেহগড়ের ইসমাইল হোসেন-সকলে বেরিলীতে এসে জড়ো হয়েছেন। তাছাড়া একদল গাজীও এসেছে ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য। তারা ছিলেন অন্যান্য সেপাইদের তুলনায় অধিক বয়স্ক মানুষ। বিলম্বিত শশুবিমণ্ডিত এই যোদ্ধাবৃন্দের মাথায় ছিলো সবুজ পাগড়ি, সে সঙ্গে সবুজ কোমরবন্দ পরণে। কোরানের আয়াত লেখা একটি রূপপার আংটি তারা পরিধান করতেন। খান বাহদুর খান ব্রিটিশ সেনার ব্যাপক প্রস্তুতির বিষয়ে ওয়াকেবহাল ছিলেন। তিনি ইচ্ছা করলে এই যুদ্ধ অনায়াসে এড়িয়ে গা ঢাকা দিয়ে চলে যেতে পারতেন। পিলিবেতের রাস্তা তখনো ভোলা ছিলো। কিন্তু উত্তপ্ত রোহিলা-রক্ত তাঁকে শেষবারের যুদ্ধ করতে প্ররোচিত করলো।
যখন শুনলেন যে ব্রিটিশ সেনাপতি কলিন ক্যাম্পবেল তার রাজধানীর দিকে ছুটে আসছেন, তিনি অতি সত্বর শহর থেকে বহির্গত হলেন এবং নাকাতিয়া নদী অতিক্রম করে উন্মুক্ত প্রান্তরে বাধা দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শহরের নিকটবর্তী পুরানো ক্যান্টনমেন্টে দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করলেন। মে মাসের ৫ তারিখে সকাল বেলা ব্রিটিশ সৈন্য বিদ্রোহীদের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। আনুমানিক বেলা সকাল সাত ঘটিকার সময় অশ্বারোহী এবং গোলন্দাজ সৈন্য দু’দিক থেকে সাঁড়াশী আক্রমণ করে বিদ্রোহী সৈন্যদের দ্বিতীয় রক্ষণ রেখার দিকে হাঁটে যেতে বাধ্য করলো। এই সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ব্রিটিশ সৈন্য নদীর অপর পার থেকে ভারী কামান বহন করে নিয়ে এলো। আনুমানিক বেলা ১১টার দিকে গাজী সেনানীরা এক দুধর্ষ হামলা পরিচালনা করে। গাজী সেনাদের এই আক্রমণ সম্বন্ধে প্রধান সেনাপতি তাঁর প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘এই রকম সঙ্ঘবদ্ধ এবং দৃঢ় আক্রমণ গোটা যুদ্ধে আমি কোথাও দেখিনি। দীন দীন রব তুলে, আল্লাহ্ আকবর ধ্বনি উচ্চারণ করে তারা পাঞ্জাব রাইফেল বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ৪২নং হাইল্যান্ডার বাহিনীর সন্নিকটে ধাবিত করে নিয়ে গেলো ও তাদের অগ্রগতি রোধ করার জন্য স্যার কলিন ক্যাম্পবেল সৈন্যদের প্রাচীরের মতো সারির পর সারি বিন্যস্ত করলেন। সুদৃশ্য ঢাল বাগিয়ে ধরে মাথার ওপর তলোয়ার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উদ্যত সঙ্গীনের প্রাচীরের কেন্দ্ৰমুখে অগ্রসর হতে থাকে। জানের পরোয়া না করে গাজী সেনা এবং সাধারণ সেনা সঙ্গীনের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে। দু’জন কিংবা তিনজন জেনারেল ওয়ালপেপালকে ঘিরে আক্রমণ করে বাহুমূলে আঘাত করলো। তার দেহরক্ষীর সহায়তা না পেলে হয়তো সে যাত্রা ওয়ালপোলের ভবলীলার ইতি ঘটতো। গাজীদের কেউ পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেনি। তারা এসেছিলো হয় মরতে নয় মারতে। দেখা গেলো ৪২ নং রেজিমেন্টের নিশান স্তম্ভের কাছে তাদের একশ তিরিশ জনের লাশ পড়ে রয়েছে।‘
যুবরাজ ফিরোজ শাহ্ও একটি সাহসী পদক্ষেপ পরিচালনা করেছিলেন। মে মাসের ৬ তারিখে জোনসের সেনাদল সম্পূর্ণ বিপরীত দিক থেকে বেরিলী আক্রমণ করলো। দুই সেনার মাঝখানে পড়ে বিদ্রোহী সেনাদলের একেবারে শোচনীয় অবস্থা। তারা শহর খালি করে পিলিবিতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। কেউ কেউ ব্রিটিশ সৈন্যের হাতে ধরা পড়লো এবং সঙ্গে সঙ্গে তাদের ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হলো। ৭ই মে তারিখে সেনাপতি কলিন ক্যাম্পবেল সসৈন্যে বেরিলীতে প্রবেশ করলেন। হত্যা ধ্বংস লুণ্ঠনকার্য চললো অনেক দিন ধরে। বিদ্রোহীদের সমর্থন নয় শুধু, অনেক ব্রিটিশ ভক্তের দুর্দশার অন্ত রইলো না। খানবাহাদুর অযোধ্যাতে পালিয়ে চলে গিয়েছিলেন। তাকে ধরে আনার জন্য কোককে পাঠনো হয়েছিলো। বছরের শেষদিকে তিনি অযোধ্যা থেকে আশ্রয়ের আশায় নেপালে পদার্পণ করলেন। নেপালে তিনি আশ্রয় পাবেন, এরকম একটা ভরসা পেয়েছিলেন। কিন্তু নেপাল সরকার বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁকে ব্রিটিশের হাতে সোপর্দ করলেন। কোতোয়ালীর সামনে তাকে ফাঁসি দেয়া হলো। তার মৃত্যু জনগণের মধ্যে কি রকম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিলো, কোলকাতার কট্টর ব্রিটিশ সমর্থক পত্রিকা ‘হিন্দু পেট্রিয়টের’ মন্তব্য থেকে অনুধাবন করা যায়। পেট্রিয়ট মন্তব্য করেছিলো, ‘ভদ্রলোক মৃত্যুবরণ করে তাঁর দুষ্কর্মে গৌরব সঞ্চার করেছিলেন।’