কর্তৃপক্ষ প্রত্যাশা করেছিলেন, সেপাইরা ঈদের দিনে কিছু একটা করবে। কিন্তু সেদিন কিছু ঘটলো না। ৩১শে মে তারিখে গীর্জায় সমবেত ইউরোপীয়দের ওপর আক্রমণ করে বসলো। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রিকেট ঘটনাস্থলেই নিহত হলেন। সেপাইদের বাধা দেয়ার জন্য ছুটে এলো শিখ রেজিমেন্ট। কিন্তু সেপাইরা তার আগেই ক্যান্টনমেন্টে যেয়ে ক্যাপ্টেন জেমসকে পরাজিত করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট জেনকিন পালিয়ে আত্মরক্ষা করলেন। সেপাইরা কারাগার আক্রমণ করে কয়েদীদের মুক্তি দিয়ে দিলো এবং তোষাখানা দখল করে ফেললো। কাদির আলী খানের ওপর জেলা শাসনের দায়িত্ব অর্পণ করা হলো। তিনি শোভাযাত্রা সহকারে শহর প্রদক্ষিণ করে ঘোষণা করলেন যে খান বাহাদুর খান শাসন-কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছেন। গোলাম কাদির খানকে নাজিম, নিজামুদ্দীন খান, হামিদ হাসান খান এবং খান আলী খানকে সহকারি, আবদুর রউফ খানকে সৈন্যাধ্যক্ষ নিয়োগ করা হলো। নওয়াব হাসমত আলী খানের ওপর গোলন্দাজ বিভাগের দায়িত্ব অর্পণ করা হলো। রাজপুতেরা নতুন সরকারের প্রতি সব রকমের অবজ্ঞা প্রদর্শন করে আসছিলো। মরদান আলী খান তাদের দমন করলেন এবং দলপতিকে সমুচিত শাস্তি প্রদান করলেন।
খান বাহাদুর খানের নির্দেশে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের কাজ এগিয়ে চলছিলো। বিদ্রোহী দলের নেতা ছিলেন গোলাম মুহম্মদ খান। তিনি থানা এবং তহশীল অফিসমূহ দখল করে নিয়েছিলেন। খান বাহাদুর খান তার উপর তিহারীর দায়িত্ব অর্পণ করেন। হেদায়েত আলী এবং ভাইকে গোটা পরগণা ব্যবস্থাপনার অধিকার দিলেন। তাবৎ বিদ্রোহের সময়ে গোলাম মুহম্মদ খান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বলতে গেলে গোটা মীরনপুর জেলার নেতা ছিলেন গোলাম মুহম্মদ খান এবং ফৈয়াজ খান। তাঁদের উভয়ে একটি পদাতিক বাহিনী গঠন করেছিলেন। আহমদ ইয়ার খান নামে একজন প্রবীণ কর্মচারিকে নতুন সরকারের তহশিলদারের পদ প্রদান করা হলো।
পাওয়াইনের রাজা জগন্নাথ খান বাহাদুর খানের কর্তৃত্ব অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু সরকারি সৈন্য যখন তাঁর রাজ্যে হামলা করলো, এক লাখ টাকা কর এবং তিরিশ হাজার টাকা কর নগদ নজরানা প্রদান করার অঙ্গীকার করে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হলেন।
খান বাহাদুর খান হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। তিনি যোগ্য এবং উপযুক্ত হিন্দুদের উচ্চপদে আসীন করেছিলেন। এক ফরমানে তিনি বলেছেন, সর্বগুণে গুণান্বিত, মর্যাদাবান, সাহসী রাজন্যবর্গ শুধু তাঁদের নিজেদের ধর্মের রক্ষক নন, অন্য ধর্মের প্রতিও সমানভাবে শ্রদ্ধাশীল। তথাপি তিনি অনেক সময় অনেক জমিদার এবং সামন্তের বিরুদ্ধে কঠোর পন্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তাঁদের অনেকেরই ব্রিটিশের প্রতি আনুগত্য অটুট ছিলো।
১৮৫৭ সালের জুলাই মাসে খান বাহাদুর খান কন্নি খানের নের্তৃত্বে পলাতক ইউরোপীয়দের শক্তিশালী আশ্রয়কেন্দ্র নৈনিতালে এক অভিযান প্রেরণ করেন। কিন্তু সেখানে তাঁরা বিশেষ সুবিধা করতে পারলেন না। ১৮৫৭ সালের অক্টোবর মাসে গঙ্গার অপর পারে ক্ৰক্রোপ্ট উইলসনের নেতৃত্বে একদল ঘোড়সওয়ার সৈন্য দৃষ্টিগোচর হলো। বেরিলী থেকে পলাতক ক্যাপটেন গাওয়ান এতোকাল যিনি দাতাগঞ্জের একজন হিন্দু ভূস্বামীর আশ্রয়ে অবস্থান করছিলেন এবং বিদ্রোহীদের সম্মুখীন হওয়ার সাহস করতে পারছিলেন না, তিনিই উইলসনকে তাঁর সাহায্যার্থে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
এডওয়ার্ড উইলসন দেশীয় মহিলার ছদ্মবেশে কাদিরগঞ্জে গিয়ে গাওয়ানের সঙ্গে মিলিত হলেন। আবদুর রহমানকে সৈন্যদলসহ উইলসনের বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হলো। নিয়াজ মুহম্মদ গুনাউর শহর দখল করে নিলেন। মুবারক হোসেন খানকে বদাউনের জেলা শাসকের পদ প্রদান করা হলো।
নিয়াজ মুহম্মদ খানকে ফতেহগড়ে অভিযান পরিচালনা করার নির্দেশ দেয়া হলো। তিনি সূর্যগড়ের নিকট গঙ্গা অতিক্রম করে শামসাবাদ দখল করে নিলেন। ১৮৫৮ সালের ২৭শে জানুয়ারি তারিখে স্যার হোপ গ্র্যান্ট সুতিয়াতে এসে উপনীত হলেন। তাঁর সঙ্গে একটি খণ্ডযুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। তাতে সেপাইদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে।
প্রধান বিদ্রোহী নেতাদের অনেকেই রোহিলাখণ্ডে এসে হাজির হয়েছেন। এখন রোহিলাখণ্ড প্রধান সক্রিয় রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ সেনাপতি একটি বড়ো যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করে যাচ্ছিলেন। পরিকল্পনা অনুসারে তিনটি সৈন্যদল ভিন্ন অবস্থান থেকে একযোগে বেরিলী আক্রমণ করবে, সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। কর্ণেল পেনি দোয়াব থেকে গঙ্গা অতিক্রম করে যাত্রা করবেন প্রধান সেনাপতির সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য। ব্রিগেডিয়ার ওয়ালপোল গঙ্গার পশ্চিম তীরে মার্চ করে প্রধান সেনাপতির সঙ্গে মিলিত হবেন ঠিক হলো। তৃতীয় দলটি রুঢ়কি থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোনসের অধীনে মার্চ করে আক্রমণ করবেন স্থির করা হলো।
২৪শে এপ্রিল পেনি ফতেহগড়ের উদ্দেশ্যে বুন্দেলশর ত্যাগ করলেন প্রধান সেনাপতির সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য। ২৫শে এপ্রিল তারিখে গঙ্গা পার হয়ে তার সেনাবাহিনী উশিয়াত নামক স্থানে প্রবেশ করলো। তারপরে তারা মাত্র চার মাইল দূরে কারাকালা অভিমুখে ঝড়ের বেগে অগ্রসর হতে থাকে। পথে একদল অশ্বারোহী তাঁদের বাধা দিলো। কিন্তু ব্রিটিশ সৈন্যের গতিরোধ করা গেলো না। শহরের উপকণ্ঠে মাত্র চারটি কামান গর্জন করে তাদের বাধা দিলো। ব্রিটিশ সৈন্যও কামানের ধ্বনিতে প্রত্যুত্তর দিলো। গাজীরা বীর বিক্রমে প্রতিবন্ধকতা রচনা করলো। বন্দুকধারী সেপাইদের ক্ষিপ্রতার বলে বিপত্তি এড়ানো গেলো। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই জানা গেলো যে ব্রিটিশ প্রধান সেনাপতিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ঘোড়া ভুলবশতঃ তাকে নিয়ে শত্রুশিবিরে ছুটে গেছে। সেখানে বিদ্রোহীরা তাঁকে হত্যা করে। এই যুদ্ধে মোগল রাজপুত ফিরোজ শাহ্ নেতৃত্বদান করেছিলেন। তিনি তার সৈন্যদলসহ বদাউনে চলে গেলেন। কর্ণেল জোন্স এখন ব্রিটিশ সৈন্যাধ্যক্ষের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে। তিনি প্রধান সেনাপতির সঙ্গে মিলিত হবার জন্য মীরনপুর কাটারার দিকে যাত্রা করলেন।