খান বাহাদুর খানকে সম্রাটের মনোনীত প্রতিনিধি বলে ঘোষণা করা হলো। তিনি ছিলেন অভিজাত রোহিলা কুল-তিলক। ইউরোপীয় এবং দেশীয় সকলে এই সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকটিকে শ্রদ্ধা করতেন। বিদ্রোহী নেতারা বিশেষ করে বখৃত খান তাঁকে সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছিলেন। সরকার গঠন করার পর খান বাহাদুর খান সেনাদলের পুনর্গঠনে মনোযোগী হয়ে উঠলেন। নতুন নতুন লোক সেনাদলে ভর্তি হতে লাগলো। তিনি একটা অস্ত্র নির্মাণ কারখানা তৈরি করলেন। থানা এবং তহশীলগুলো খান বাহাদুর খানের নির্দেশ মোতাবেক ভালোভাবে কাজ করে যাচ্ছিলো। গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে তিনি নিজের বিশ্বস্ত এবং কর্মক্ষম লোকদের এনে বসালেন। একটা সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি গড়ে তুললেন। ২১শে জুন তারিখে সম্রাট ফরমানের মাধ্যমে তাকে শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগের স্বীকৃতি জানালেন। খান বাহাদুর খান উভয় সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী জমিদারদের বিদ্রোহীদের পক্ষে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার নবগঠিত সেনাদলের ৯১টি অশ্বারোহী বাহিনীতে সব মিলিয়ে সৈন্যসংখ্যা ছিলো ৪৬১৬ জন এবং ৫৭টি পদাতিক বাহিনীতে সব মিলিয়ে সৈন্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ২৪৩০জন। তাদের সঙ্গে ছিলো নবনির্মিত বেরিলী অস্ত্রাগারে প্রস্তত ৪০টি কামান। তাঁর সেনাদলের পেছনে মাসিক অর্থব্যয়ের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার ৬ শত টাকা। বাদবোয়ালীর রঘুনাথ সিং খান বাহাদুর খানের কর্তৃত্ব অস্বীকার করেছিলেন। তাঁকে শাস্তি দেয়ার জন্য একদল সৈন্য প্রেরণ করা হলো। তারপরে বখৃত খানের নেতৃত্বে সম্রাটের বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ সৈন্য দিল্লীতে প্রেরণ করা হলো। পিলিবিত, শাহজাহানপুর, মুরাদাবাদ এবং বিজনৌর অনতিবিলম্বে নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে নিলো।
পিলিবিতের মুসলমানেরা ঈদের দিন ভয়ঙ্কর রকম উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলো। ঈদগাহ্ ময়দানে নানা রকম কোম্পানীর সরকার বিরোধী প্ল্যাকার্ড পুঁতে রাখা হয়েছিলো। ১লা জানুয়ারি তারিখে পিলিবিলে বেরিলীর সংবাদ এসে পৌঁছায়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ভয় পেয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থান নৈনিতালে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলো। কতিপয় রাজপুত পরিবার নতুন সরকারের বিরোধিতা করেছিলো। তাদের দমন করার জন্য মরদান আলীর অধীনে একদল সৈন্য প্রেরণ করা হলো এবং অতি সহজে তাদের দমন করা গেলো।
জেলা শহর আওনালায় এক সময়ে রোহিলা সর্দারদের সদর দফতর অবস্থিত ছিলো। এখনো সেখানে রোহিলাদের বংশধরেরা বসবাস করছিলেন। কল্লান খানকে আওনালা শাসন করার দায়িত্ব দেয়া হলো। তিনি ছিলেন অতিশয় সুপুরুষ এবং কর্মক্ষম ব্যক্তি। মৌলবি মুহম্মদ ইসমাইল, গালিব আলী, শেখ খায়েরুল্লাহ এবং হাকিম সৈয়দুল্লাহ প্রমুখকে তাঁর সহকারী হিসেবে নিয়োগ করা হলো।
সমগ্র দিল্লী সাম্রাজ্যের মধ্যে বদাউন ছিলো অতিশয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থান। সে কারণে এর রাজনৈতিক গুরুত্ব একেবারে উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। রোহিলাখণ্ডের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এই জেলাটিও ১৮৫১ সালে কোম্পানীর শাসনাধীনে চলে আসে এবং মুরাদাবাদ জেলার সঙ্গে একে যুক্ত করে দেয়া হয়। পরে ১৮৫৭ সালে বদাউনকে আলাদা একটি জেলা করা হয়। ১৫ই মে তারিখে বিদ্রোহের সংবাদ বদাউনে এসে পৌঁছায়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট উইলিয়াম এডওয়ার্ডের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, সেপাইরা ভয়ঙ্কর রকম অস্থির এবং অশান্ত হয়ে উঠেছে। স্থানীয় সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কারণেই এখনো এখানে শান্ত অবস্থা বিরাজ করছে। এডওয়ার্ড জানতে পারলেন যে ঈদের দিন একটা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
এডওয়ার্ড সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে জেলার গণ্যমান্য সম্ভ্রান্ত সকল মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার ছল করে ঈদের দিন পর্যন্ত আটকে রাখলেন। তার ফলে হিতের বদলে বিপরীত ঘটলো। সেপাই এবং জনসাধারণের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো। ২রা জানুয়ারি তারিখে বেরিলী থেকে ৬৮নং রেজিমেন্টে কিছু সৈন্য এসে পৌঁছোবার সঙ্গে অভ্যুত্থান ঘটে। এডওয়ার্ড কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে পলায়ন করলেন। তিনি অতিকষ্টে ১লা সেপ্টেম্বর তারিখে কানপুর এসে উপস্থিত হলেন।
বিদ্রোহীরা শাসনভার গ্রহণ করলো। আবদুর রহমানকে নিজাম পদে এবং শেখ ফাসাত উল্লাহকে তাঁর সহকারি পদে অধিষ্ঠিত করা হলো। ময়েজউদ্দিনকে প্রধান সেনাপতির কর্তৃত্ব দেয়া হয়। আজম উল্লাহ খানকে বখশীর পদ, ওয়ালীদাদ খান চৌধুরী, তোফাজ্জল এবং কেরামতুল্লাহকে সামরিক বিভাগের সহকারীর দায়িত্ব দেয়া হলো। শুরু থেকেই রাজপুতেরা নতুন সরকারের বিরোধিতা করে আসছিলেন। একজন রাজপুত জমিদার ‘ধাপধুম’ খেতাব গ্রহণ করে সসৈন্যে বদাউনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। নগরীর উপকণ্ঠে তাকে বাধা দিয়ে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা হলো। আরো একটা রাজপুত বিদ্রোহ দমন করা হলো। গুনাউরের ঠাকুরেরা বরাবরই ব্রিটিশের প্রতি অনুগত ছিলেন। জমিদার বিশ্বনাথ নতুন সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে তাকেও দমন করা হলো।
শাহজাহানপুর ছিলো রোহিলাখণ্ডের আরেকটি জেলা। এখানে মৌলবি সরফরাজ আলী অভ্যুত্থান হওয়ার অনেক পূর্বে থেকেই জিহাদের বাণী প্রচার করে আসছিলেন। শাহজাহানপুরের কালেক্টর এ বিষয়ে রিপোর্ট করে লিখেছিলেন, আজ সন্ধ্যায় সেপাইরা দল বেঁধে বেরিলীর দিকে যাত্রা করেছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে সরফরাজ আলী নামে গোরক্ষপুরের একজন মৌলবী। এ থেকে মনে হয় ঐ লোকটি অন্ততঃ বিশদিন আগে শাজাহানপুরে এসেছে এবং সেপাইদের বিদ্রোহ করার জন্য উত্তেজিত করার ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে। সরফরাজ আলীর কয়েকজন শিষ্য শাহজাহানপুরে এসেছে। ফৈজাবাদ সেরেস্তার নায়েব কুদরত আলী এবং তার ভাই নিয়াজ আলী হলো, তাদের মধ্যে দু’জন। আগে থেকেই মৌলবীরা তাদের কাছে যাওয়া-আসা করতো। এই দুই ভাইও বিদ্রোহী সেপাইদের সঙ্গে রয়েছে।