খ্রীস্টান ধর্ম প্রচারকেরা শিক্ষক হিসেবে সুযোগ্য। তাদের শিক্ষাদান শুধু ছাত্রদের মন উন্নত করার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ রইলো না, তারা ছাত্রদের আত্মা শুদ্ধ করার জন্যও উঠে-পড়ে লেগে গেলো। এর ফলে জনগণের মধ্যে উদ্বেগের সঞ্চার হলো। তারা প্রচার করতে লাগলো-খ্রস্টধর্মই হলো সত্যের একমাত্র পন্থা। শিক্ষিত হিন্দুরা সহিষ্ণু মনোভাব নিয়ে বিচার করতে লাগলো সব ধর্মই ভগবানের কাছে পৌঁছার পথ। কিন্তু মুসলমানেরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, একমাত্র ইসলামই সর্বশেষ সত্য ধর্ম। অপরপক্ষে, অধিকাংশ হিন্দু যারা অশিক্ষিত বিশ্বাস করে যে, সনাতন আচার-অনুষ্ঠান থেকে একটু নড়চড় হলেই তারা ধর্ম থেকে পতিত হবে। সুতরাং এদেশীয় ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে খ্রীস্টান ধর্ম বিশ্বাসের সংঘর্ষ চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হলো। ভারতীয়েরা মনে করতে লাগলো অন্যায্যভাবে খ্রীস্টধর্ম তাদের পিতৃপুরুষের ধর্মের ওপর আঘাত হানছে। অনেক সময় সরকার প্রকাশ্যে তাতে সহায়তা দান করছে। খ্রীস্টধর্ম প্রচারের আদর্শে অনুপ্রানিত কতিপয় সরকারি এবং সামরিক অফিসার ভাবতে লাগলেন এ ধর্মহীন ভারতীয়দের তারা যদি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সত্য ধর্মের আলোকে দীক্ষিত না করে, তাহলে স্বর্গপ্রাপ্তির মহামূল্য সুযোগ হেলায় হারিয়ে ফেলবেন। আবার অনেকের মনের ধারণা শাসক এবং শাসিতের মধ্যে যে ব্যবধান রয়ে গেছে, দেশীয় অধিবাসীদের খ্রীস্টধর্মে দীক্ষিত করতে পারলেই সে ফাঁক ভরাট হয়ে যাবে। খ্রীস্টান প্রচারকদের পরিচালিত বিদ্যালয়সমূহে তো বটেই অধিকন্তু কতিপয় সরকারি বিদ্যালয়েও বাইবেল শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলো। হেনরী কেয়ারটুকার নামে একজন প্রচারক এ পদ্ধতির পুরোপুরি সমর্থক ছিলেন। তিনি কানপুরের অবৈতনিক বিদ্যালয় প্রসঙ্গে বলেছেন, বারানসীর জয়নারায়ণ অবৈতনিক বিদ্যালয় সরকারি হলেও পাদরীরা কড়াকড়িভাবে খ্রীষ্ট্রীয় পদ্ধতিতেই তার শিক্ষাদানের ভার গ্রহণ করেছে। স্যার সৈয়দ আহমদ বাইবেল পড়ানোর জন্য ততোটা আপত্তি করেননি, কিন্তু পড়ানোর ধরন সম্বন্ধে ভয়ানক আপত্তি তুলেছেন। তিনি অভিযোগ করে বলেছেন, কোন কোন বিদ্যালয়ে ছাত্রদের জিজ্ঞেস করা হয় তোমাদের প্রভু কে এবং কে তোমাদের মুক্তিদাতা? ছাত্ররা শেখানো খ্রীস্টীয় পদ্ধতিতেই তার উত্তর দিয়ে থাকে। তার মতে, সামরিক পুরোহিত এবং সামরিক অফিসারেরা তাদের অধীনস্থ কর্মচারীদের সঙ্গে ধর্ম বিষয়ে আলাপ করে তাদের প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করতো।”
খ্রীস্টধর্ম প্রচারকদের কর্মতৎপরতা শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না। রেভারেণ্ড গোপীনাথ নন্দী নামে একজন বাঙালি যাজক ছিলেন ফতেহপুরে। সে সময়ে আর. টি. টুকার ছিলেন ফতেহপুরের জেলা শাসক। তিনি লিখেছেন, প্রত্যেক দিন জেলখানায় একজন খ্রীস্টান যাজক কয়েদিদের মধ্যে খ্রীস্টীয় নীতিমালা প্রচার করতেন এবং আমি প্রতি রবিবার সকাল বেলা তাদের মধ্যে সুসমাচার প্রচার করতাম। আমাদের ধর্মপ্রাণ মেজিস্ট্রেট এ সুবিধা করে দিয়েছেন। প্রশাসক, বিচারক এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারিদের সকলেই প্রচারকার্যে সক্রিয় সহযোগিতা দান করেছিলেন। তারা আমাদের প্রার্থনাসভা পরিচালনা, সদুপদেশ এবং আর্থিক সহায়তা দান করেছেন। এ দেশীয় দীক্ষিতদের সংখ্যা যখন বৃদ্ধি পেতে থাকলো, সম্মানীয় মি: কলভিনের পরামর্শে তাঁদের ছ’জনকে কৃষক গেরোস্তে পরিণত করা হলো। এভাবেই ফতেহপুরের জেলা শাসক কয়েদিদেরকে ধর্মান্তরিতকরণে সাহায্য করেছিলেন এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সহকারী গভর্ণর নিজে এ সকল নবদীক্ষিতদের বৈষয়িক উন্নতির প্রতি যত্নবান হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণ মানুষের মনে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হলো যে, সরকার প্রজাদের খ্রীস্টানে পরিণত করার মনোভাব গ্রহণ করেছেন।
১৮৪৫ সালে জেলে খাবার পদ্ধতি নিয়ে নতুন আইন প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বিশ্বাস তাদের মনে আরো পল্লবিত হয়ে উঠলো। ভারতীয় কারাগারে কতিপয় কয়েদিকে অন্য সকল কয়েদিদের পাঁচকরূপে নিয়োগ করা আজকের দিনের অতি সাধারণ পদ্ধতি। আগেকার দিনে কারাগারের কয়েদিরাও কড়াকড়িভাবে তাদের স্ব স্ব গোত্রের নিয়মকানুন পালন করতো। কয়েদিদেরকে আপন আপন খাবার পাক করতে দেয়া হতো। এ ব্যবস্থায় অসুবিধার অন্ত নেই। সেজন্য সকলের পাক করার জন্যে একজন ব্রাহ্মণকে নিয়োগ করা হলো। তার ফলে বর্ণ হিন্দুরা অত্যন্ত অপমানিত অনুভব করলো। ব্রাহ্মণদের মধ্যেও আবার বহু শ্ৰেণী গোত্র রয়েছে। একের ছোঁয়া অপরে খায় না। সরকার তাদেরকে ধীরে ধীরে খ্রীস্টানে পরিণত করতে চায়, এ বিশ্বাস তাদের মনে শিকড় প্রসারিত করতে লাগলো। জনগণের মধ্যে নয় শুধু সেনাবাহিনীতেও গুজব ছড়িয়ে পড়লো, সরকার সেখানেও সাধারণ মেস প্রথা চালু করবে। তার ফলে ১৮৪৫-৪৬ সালে পাটনা ষড়যন্ত্রের উদ্ভব হয়। তারপরেও কিন্তু কতিপয় কারাগারে নতুন ব্যবস্থা বলবৎ থাকে। জনমত ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলো, খান বাহাদুর খানের কথায় তার প্রমাণ মেলে। “তারা জোর করে কয়েদিদেরকে রুটি খাইয়ে তাদের ধর্মে দীক্ষিত হতে বাধ্য করে।”