বেরিলী ছিলো রোহিলাখণ্ডের প্রধান শহর। এখানেই ছিলো হাফেজ রহমত আলী খানের রাজধানী। সেই একই সঙ্গে বেরিলীতে অবস্থিত ছিলো বিভাগীয় কমিশনারের সদর দফতর। ভৌগোলিক অবস্থান এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে বেরিলীর ছিলো অপরিসীম গুরুত্ব। মুজাহিদ মৌলবি সরফরাজ আলী, সদর আমীন মৌলবি এনায়েত আহমদ এবং জান্দুশাহ নামে একজন ফকির প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ ছিলেন বিদ্রোহের ধ্বজাধারী ব্যক্তিত্ব। আর সকলের চালকের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন খান বাহাদূর খান স্বয়ং। তিনি ছিলেন হাফেজ রহমত আলী খানের পৌত্র এবং কোম্পানীর একজন অবসরপ্রাপ্ত বেসামরিক কর্মচারি। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারি হিসেবে এবং প্রতাপশালী রোহিলা সর্দারদের উত্তর পুরুষ হিসেবে, দুইভাবে কোম্পানীর সরকারের কাছ থেকে পেনসন পেতেন। বিভাগীয় কমিশনার তাঁকে অতিমাত্রায় বিশ্বাস এবং সম্মান করতেন। বেরিলী এবং বেরিলীর আশেপাশের সকল অঞ্চলে তিনি ছিলেন সকলের তর্কাতীত শ্রদ্ধার পাত্র। বিদ্রোহের শুরুতে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে তিনি ইংরেজ আনুগত্য বর্জন করে সরাসরি বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দান করবেন।
১৮৫৭ সালের মার্চে মীরাটের সেপাইদের মধ্যে যে অসন্তোষ সঞ্চার হয় রোহিলাখণ্ডে তার ঢেউ এসে লাগতে মাস খানেক সময় অতিবাহিত হয়। ইউরোপীয় অফিসারেরা অত্যন্ত সন্তোষজনকভাবে সেপাইদের যাবতীয় ক্ষোভ নিরসন করেন। কিন্তু তারপরেও বিদ্রোহী চিন্তা-চেতনা একইভাবে জনগণ এবং সেপাইদের মধ্যে প্রসার লাভ করতে থাকে। দিল্লীর পতনের সংবাদ সেপাইদের উত্তেজনা ভয়ানকভাবে বাড়িয়ে তোলে। প্রত্যেক দিন দিল্লী থেকে নতুন মানুষ এসে নতুন নতুন চমকপ্রদ গুজব ছড়াতে থাকে। ফরেস্টের বর্ণনা তাই আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। আবার আরেকজন মোগল রাজধানীতে স্বহস্তে শাসনভার গ্রহণ করেছেন, এ সংবাদে রোহিলা পাঠানদের মধ্যে সুপ্ত ধর্মোন্মাদনা এবং সমর তৃষ্ণা জেগে ওঠে। তাঁরা সকলে ছিলেন একই নবীর অনুসারী, সুতরাং তাদের ধর্মশাস্ত্রের মধ্যেই উত্তেজিত করে তোলার এন্তার উপাদান সঞ্চিত ছিলো। প্রাচীন জমিদারেরা তো পূর্বে থেকেই কোম্পানীর সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন। সাম্প্রতিককালে অন্যান্য ব্যবসায়ী এবং ব্যাঙ্ক মালিকদের মধ্যে আতঙ্কের সঞ্চার হয়েছে। বিদ্রোহের ধারক বাহকেরা সরকারের নামে বিশ্বাস্য-অবিশ্বাস্য নানা রকমের গুজব রটাতে লাগলো। এক সময়ে সকলে বলাবলি করতে লাগলো যে সরকার বাজারে চামড়ার টাকা চালু করবে এবং সারা দেশে যতো রূপা আছে সব জোর করে কেড়ে নিয়ে যাবে।
১৪ই মে তারিখে মীরাটের সংবাদ এসে পৌঁছলো। ইউরোপীয় মহিলা এবং শিশুদের নৈনিতালে পাঠিয়ে দেয়া হলো। ব্রিগেডিয়ার সে সময় কার্যক্ষেত্রে অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁর স্থলে দায়িত্বে ছিলেন কর্ণেল টুপ। কর্ণেল বিশ্বাস করতেন যে তাঁর সকল সৈন্যের মধ্যে একমাত্র ৮ম রেজিমেন্টই তার প্রতি অনুগত থাকবে। ম্যাকেঞ্জী ছিলেন স্টেশন কমান্ডার। তিনি এই বিশ্বস্ত রেজিমেন্টের শক্তি বৃদ্ধি করলেন। প্যারেড ময়দানে সৈন্যদের নিয়ে যেয়ে জানালেন যে বেরিলীতে কোনো কার্তুজ আসবে না, আর যদি আসে তাহলে তিনি তাদের সকলের সামনে প্যারেড ময়দানে সেগুলো নষ্ট করে ফেলবেন। মৌলবি মোহাম্মদ আহসান নামে স্থানীয় কলেজের এক শিক্ষককে দিয়ে সেপাইদের সামনে ওয়াজের আয়োজন করলেন। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। সেপাইদের মধ্যে তাঁর বক্তৃতার উল্টো প্রতিক্রিয়া হলো। তাঁকে লজ্জায় অপমানে চিরতরে বেরিলী ছেড়ে চলে যেতে হয়। তারপরের দিন ছিলো ঈদুল ফিতরের দিন। মৌলবি রহিমুল্লাহ ঈদের দিন ঐ একই মসজিদে জেহাদের বাণী প্রচার করেন। কিন্তু কোতোয়াল বাধা দেয়। সেই সময় বখ্ত খান বেরিলীতে ছিলেন। কুতুবশাহ্ নামে ঐ কলেজের আরেকজন শিক্ষক সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে যে তিনি ছিলেন খান বাহাদুর খানের ঘোষণাপত্রের প্রকৃত লিপিকার। বিচারের সময় মৌলবি রহিমুল্লাহকে ওহাবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শুরু থেকেই বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি খান বাহাদুর খানের কাছে থেকে মাসিক ১৫০ টাকা নিতেন। যুবরাজ ফিরোজ শাহ্ যখন মুরাদাবাদ দখল করেন, সেই সময়ে মৌলবি সাহেব তার সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছিলেন।
সিভাল্ড ফিরে এলে ২১শে মার্চ তারিখে আরেকবার প্যারেড করার নির্দেশ দেন। তিনি নানারকম নিশ্চয়তা দান করে সেপাইদের ক্ষোভ সাময়িকভাবে প্রশমিত করেন। এ সম্পর্কে দু’দিন পরে সরকারের কাছে রিপোর্ট করেছেন যে “সেপাইদের মধ্যে আবার আনুগত্য এবং আনন্দের ভাব ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। আমি চূড়ান্তভাবে সফল হয়েছি এবং তাদেরকে এতো দূরে বশে এনে ফেলেছি যে যেখানেই প্রয়োজন হবে অনুগত সেপাই হিসেবে যেতে অস্বীকার করবে না।’ সিভালুডের পরিস্থিতি বিচার যে সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত ছিলো অত্যল্পকাল সময়ের মধ্যেই তা সপ্রমাণিত হলো। এক সপ্তাহ না যেতেই একজন হিন্দু রিসালদার কর্ণেল টুপ-এর কাছে জানালেন যে ১৮নং এবং ৮নং দেশী পদাতিক রেজিমেন্ট ঐ দিনেই বেলা দু’টার সময় সেপাইরা অভ্যুত্থান করবে। কিন্তু সেদিন কিছুই ঘটলো না। কিন্তু মাসের শেষ তারিখে একজন ব্রিটিশ অফিসারের গৃহে অগ্নি সংযোগ করা হলো। এতে ইউরোপীয়রা সচকিত হয়ে উঠলো। পরের দিন বেলা এগারোটার সময় একটা কামান বিস্ফোরণের আওয়াজ পাওয়া গেলো এবং সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকের গুলি। সিভাণ্ড দ্রুত অশ্বারোহী বাহিনীর রেজিমেন্টের দিকে ধাওয়া করলেন, কিন্তু পথে তাঁকে গুলি করা হলো। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলেন। ম্যাকেঞ্জী তাঁর সেপাইদের সরকারের প্রতি অনুগত রাখতে বারবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সেপাইরা চীৎকার করে জানিয়ে দিলো যে তারা ধর্ম ছাড়া আর কোনো কিছুর প্রতি অনুগত থাকবে না। একটি সবুজ রঙের পতাকা উত্তোলন করা হলো। কারাগার ভেঙ্গে সমস্ত কয়েদীদের মুক্তি দিয়ে দেয়া হলো এবং বিদ্রোহীরা শাসনভার গ্রহণ করলো।