ঝাঁসীর পতন হলো। পেশোবার সৈন্যের সদর দফতর কল্পি এখনো বিদ্রোহীদের হাতে। সেখানে বিদ্রোহী নেতাদের সভা বসলো। রাও সাহেব,, বান্দার নওয়াব এবং ঝাঁসীর রাণী এক সঙ্গে সভা বসলো। রাও সাহেব বান্দার নওয়াব এবং ঝাঁসীর রাণী একসঙ্গে করতে যুদ্ধ লাগলেন। কিন্তু ২৩ তারিখের প্রচণ্ড যুদ্ধের পর বাধ্য হয়ে তাদেরকে কল্পিও ছাড়তে হলো। কল্পির পতনের পর বিদ্রোহী নেতৃবৃন্দ পুনরায় এক সভা আহ্বান করলেন। সেখানে সেপাইদের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হলো না। তাঁর রাজ্যের অনেক জায়গা ঘুরে সিন্ধিয়া ১৭ই নভেম্বর তারিখে কোটালকী সরাই নামক স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান।
সেদিন ব্রিগেডিয়ার স্মিথ যখন কোটালকী সরাই থেকে গোয়ালীয়রের সেপাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন তখন ঝাঁসীর রাণী বীরাঙ্গনা লক্ষ্মীবাই মৃত্যুমুখে পতিত হন। এ প্রসঙ্গে দু’টি কাহিনী প্রচলিত আছে। ম্যাকফারসান লিখেছেন, ফুলবাগ কামানের কাছে আমি দেখতে পেলাম ঝাঁসীর রাণী নিথর হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর শরীরে প্রাণ স্পন্দনের চিহ্ন নেই। তাঁর চাকর জানালা তিনি সেখানে বসে সুরা পান করছিলেন। নিকটে ছিলো চারশোর মতো অনিয়মিত সেপাই। ব্রিটিশ সৈন্য আসছে বলে যখন ডঙ্কা বাজিয়ে দেয়া হলো পনেরো জন ছাড়া আর সকলেই পালিয়ে গেলো। রাণীর ঘোড়া লাফ দিয়ে খাল অতিক্রম করতে পারলো না। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন এবং মাথায় চোট লেগেছিলো তার। তারপরে ঘোড়া থেকে ঢলে পড়ে গেলেন এবং নিকটস্থ বাগানে তাঁকে দাহ করা হয়।
কিন্তু স্যার রবার্ট হ্যামিলটন এ প্রসঙ্গে বর্ণনা দিয়েছেন তা একটু ভিন্নতর। সে যাক, যেভাইে জীবনাবসান ঘটুক না কেন, তিনি প্রকৃত বিক্রমশালী বীরাঙ্গনার মতো মৃত্যুবরণ করেছেন। ব্রিটিশ সৈন্য রাণী লক্ষ্মীবাঈয়ের মতো আর কাউকে অমন ঘৃণা করেনি। শৌর্যে-বীর্যে, ক্ষিপ্রতায় এ রকম উদ্দীপনা সঞ্চারী মহিলা পৃথিবীর ইতিহাসে অধিক দেখা যায় না।
৮. অবনমিত রোহিলা ঝাণ্ডা
রোহিলা সদারদের নিবাসভূমি রোহিলাখণ্ড। পশ্চিমে গঙ্গা অববাহিকার ওপরদিকের অযোধ্যা থেকে শুরু করে পূর্বদিকে যমুনা নদীর তীর পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডই রোহিলাখণ্ড। ছোটো-বড়ো রোহিলা সদারদের রাজ্যপুঞ্জের শিথিল সমবায়ে গঠিত এর রাজনৈতিক বুনিয়াদ। রোহিলা সদারেরা ছিলেন কাশ্মীরের রুহ নামক স্থানের অধিবাসী। তাঁরা এই অঞ্চলে আগমন করে বসবাসের জন্য এই স্থানকে পছন্দ করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে রোহিলাখণ্ড নামটি সংযুক্ত হয়।
দাউদ খান নামে এক ভাগ্যান্বেষী উদ্যোগী ব্যক্তি সর্বপ্রথম এই অঞ্চলে নিজের বাসভূমির পত্তন করেন। অধ্যবসায় এবং বিচক্ষণতার বলে কালক্রমে তিনি এই অঞ্চলের এক বৃহৎ সামন্ত ভূস্বামী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
দাউদ খানের পালকপুত্র আলী মুহম্মদ খান তার রাজ্যের সীমানা অনেক গুণে সম্প্রসারিত করেন। প্রকৃত প্রস্তাবে এই দাউদ খানই রোহিলা শক্তির প্রতিষ্ঠাতা। তিনি রায় বেরিলী জেলার আওনালায় তাঁর সদর দফতর স্থাপন করেন। মোগল সম্রাট তাঁর কার্যে প্রসন্ন হয়ে তাঁকে নওয়াব নিযুক্ত করেন। অন্যান্য প্রতাপশালী রোহিলা সদার যেমন- হাফেজ রহমত খান, দুন্দু খান তার অধীনে চাকুরি গ্রহণ করেণ। তিনি ১৮৪৯ সালে পরলোক গমন করেন।
আলী মুহম্মদ খানের মত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ সন্তান সাদ আল্লাহ্ খান সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং হাফেজ রহমত খানকে তার অভিভাবক নিয়োগ করা হয়। সাদ আল্লাহ খান ছিলেন অতিশয় পরাক্রান্ত এবং সাহসী শাসক। তার সময়ে এক রোহিলাখণ্ডই ছিলো গোটা মোগল সাম্রাজ্যের একমাত্র সুশাসিত প্রদেশ। কোম্পানী ভারতের প্রাদেশিক রাজ্যসমূহের শাসন-শৃঙ্খলার অবনতি, আন্তঃকলহ ইত্যাদির সুযোগ গ্রহণ করে ধীরে, কিন্তু সুনিশ্চিতভাবে একের পর এক রাজ্যগুলো গ্রাস করে আসছিলো। রোহিলাখণ্ডে সে রকম গোলমাল এবং অরাজকতা না থাকায় স্বভাবতঃই কোম্পানীর কর্তাব্যক্তিরা এই রাজ্যটির প্রতি ঈর্ষার চোখে তাকাতেন।
১৭৭৪ সালে অযোধ্যার নওয়াব এবং সম্মিলিত সেনাবাহিনী রোহিলাখণ্ডের ওপর আক্রমণ চালায়। সম্মিলিত বাহিনীর যৌথ আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে প্রবলভাবে যুদ্ধ করে রোহিলারা বাধ্য হয়ে পরাজয় বরণ করেন। যৌথ সেনাবাহিনী গোটা রোহিলাখণ্ডে অত্যাচারের প্লাবন বইয়ে দেয়। ১৭৭৫ সালের ১০ই জানুয়ারি লিখিত বিবৃতিতে স্বয়ং হেস্টিংস স্বীকার করেছেন যে হাজারের ওপরে গ্রাম ধ্বংস করেছি। ঝড়-বৃষ্টির বাধা না পেলে অবশ্যই আমরা আরো অনেক বেশি ধ্বংসকার্য করে যেতাম।’ সে যাহোক ছোট্ট রামপুর রাজ্য বাদে বাকি রোহিলাখণ্ডের সবটাই অযোধ্যার নওয়াবের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলো। তার সাতাশ বছর পরে লর্ড ওয়েলেসলী অযোধ্যার তৎকালীন নওয়াব সাদত আলী খানকে তার রাজ্যের অর্ধাংশ কোম্পানীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য করেন। এভাবে উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে রোহিলাখণ্ড ব্রিটিশ শাসনাধীনে চলে আসে।
১৮১৪ সালে ব্রিটিশ প্রশাসন বেরিলী শহরে প্রত্যেক গৃহের ওপর বিশেষ কর ধার্য করেন। শহরের জনগণ ভয়ানক রকম ক্ষিপ্ত হয়ে এই অন্যায় কর রোধ করার প্রতিবাদে মেতে উঠেন। জেলা প্রশাসন জনগণের অনুরোধ প্রতিবাদ সবকিছু অগ্রাহ্য করলো। মৌলবি মুহম্মদ এবাদ এক ব্যক্তি জনগণের এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সব জায়গায় জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলতে থাকেন। ১৮১৬ সালের ১৬ই এপ্রিল তারিখে কোতোয়ালী বিক্ষোভরত জনতাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গুলি করার হুকুম দিলে কয়েকজন হতাহত হয়। এই ঘটনার পরে মুফতি মুহম্মদ বিক্ষুব্ধ জনতাকে হোসাইনীবাগে নিয়ে যেয়ে জেহাদ ঘোষণা করেন। তারপরে ২১শে এপ্রিল তারিখে এই জেহাদী জনতা সরকারের সৈন্যের ওপর হামলা চালায়। ক্যাপটেন ক্যানিংহামের নেতৃত্বে মুরাদাবাদ থেকে নতুন সৈন্য এলে শীগগির তাঁদের পরাজয় মেনে নিতে হয়।